একনজরে “মাদার অফ ডেমোক্রেসি” বেগম খালেদা জিয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
রবিবার, মার্চ ২৭, ২০২২ ১০:৩১ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
রবিবার, মার্চ ২৭, ২০২২ ১০:৩১ অপরাহ্ণ
বেগম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন।
গৃহবধূ থেকে বের হয়ে রাজপথে এসেছেন দেশনেত্রী আপসহীন নেত্রী বাংলাদেশের গণমানুষের নন্দিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যেদিন প্রিয় এই নেত্রী স্বাধীন বাংলাদেশে রাজপথে আসেন সেদিন ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। স্বৈরশাসনের অন্ধকারে নিমজ্জিত স্বদেশে তিনি হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা, অন্ধকারের অমানিশা দূর করে আলোর মশাল হাতে পথযাত্রী হয়ে যার আবির্ভাব । দীর্ঘ ৯ বছর অত্যাচার অবিচার, জেল জুলুম সহ্য করে, নিষ্ঠা ও সততা ও দক্ষতার সাথে বিরাট দল বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে তিনবার গণরায়ে অভিষিক্ত হয়ে সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা যোগ্যতায় স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। জাতি যখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, সেই দুঃসময়ে তিনি দলের হাল ধরেন। পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সামরিক শাসনের দুঃশাসনে নিপতিত। স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশে আজ ভোটের অধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই। কথিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করছে।দিনের ভোট রাতে হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক হরে বিনা ভোটে নির্বাচিত হচ্ছে। দেশের এ সঙ্কটকালে দেশবাসী তাকিয়ে আছে আপোষহীন দেশনেত্রী, মাদার অফ ডেমোক্রেসি বেগম জিয়ার সংগ্রামী নেতৃত্বের প্রতি।
খালেদা জিয়ার জীবন ঘটনাবহুল। ব্যবসায়ী পিতার কন্যা সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে। স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে বন্দিজীবন কাটানো দুই সন্তানের মা খালেদা জিয়া দেশের সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হিসেবে বর্ণাঢ্য জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
আবার স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হারিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করতে না করতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
তেমন কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির হাল ধরেন তিনি।
রাজনীতিতে বেশ সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন তিনি। চারবারের সংসদে পাঁচটি করে আসনে বিজয়ী হন তিনি। আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনবার দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন। আবার খালেদা জিয়ার সব সরকারই কমবেশি নানা বিতর্ক ও ব্যর্থতার জন্য আলোচিত-সমালোচিত। যার জের ধরে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যেতে হল তাকে।
একনজরে খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের জলপাইগুড়ি জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজীতে। পিতা ব্যবসায়ী ইস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার দিনাজপুরের চন্দবাড়ির মেয়ে। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়।খালেদা জিয়ার শৈশব ও কৈশোর পার করেছেন দিনাজপুরের মুদিপাড়া গ্রামে। ১৯৬০ সালে দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশনে উত্তীর্ণ হন খালেদা খানম পুতুল। পরে তিনি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া করেন । কলেজে পড়ার সময় তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
১৯৬৫ সালে স্বামীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে যান। ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত করাচিতে ছিলেন। এর পর ঢাকায় আসেন। কিছু দিন জয়দেবপুর থাকার পর জিয়াউর রহমানের পোস্টিং হলে চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় চলে যান।
জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়া দম্পতির দুই সন্তান তারেক রহমান পিনু আর প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি কিছু দিন আত্মগোপনে ছিলেন। পরে ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। বড়বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ জুন পর্যন্ত ছিলেন। ২ জুলাই সিদ্ধেশ্বরীতে এস আব্দুল্লাহর বাসা থেকে পাকসেনারা তাকে ও তার দুই ছেলেকে বন্দি করে। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন।
ছোট ছেলে কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান। ১৯৮১ সালের ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন।
স্বামী নিহত হওয়ার আগপর্যন্ত গৃহবধূই ছিলেন খালেদা জিয়া। দুই ছেলেকে লালন-পালন ও ঘরের কাজ নিয়েই সময় কাটাতেন।
জিয়াউর রহমান দেশের প্রেসিডেন্ট হলেও রাজনীতিতে তার উপস্থিতি ছিল না। পরে দলের নেতাকর্মীদের আহ্বানে বিএনপির হাল ধরেন তিনি। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে একসময় তাকে রাজনীতিতে নামতে হয়েছে।নীতি ও আদর্শে অটুট থাকায় তিনি আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। খালেদা জিয়া তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে তিনি একটানা ৩২ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন। বছরখানেক যেতে না যেতেই নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় প্রশংসা অর্জন করেন।পরের বছর মার্চে তিনি দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদোন্নতি পান। এক মাস পর ১ এপ্রিল তিনি দলের বর্ধিতসভায় প্রথম বক্তৃতা করেন।বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অসুস্থ হলে তিনি ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এবং একই বছরের ১০ মে চেয়ারপারসন পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
১৯৯৩ সালে ১ সেপ্টেম্বর দলের চতুর্থ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বার এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের দশম কাউন্সিলে চতুর্থবারের মতো বিএনপির চেয়ারপারসন হন।
বিএনপির দায়িত্ব নেয়ার পরই নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েন খালেদা জিয়া। দল ঐক্যবদ্ধ রেখে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে কোনো রকম সমঝোতা না করেই আপসহীন আন্দোলন করে গেছেন। ফলে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে।১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত-দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই বছর সেপ্টেম্বরে জোটের মাধ্যমে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন।১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফায় আন্দোলন চলতে থাকে। ওই বছর ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাতেও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দমে যাননি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল ভেঙে আট দল ও পাঁচ দল হয়ে যায়। ৮ দল নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত ও পাঁচ দল নতুন করে আন্দোলন শুরু করে।১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। একটানা নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি।খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হন। এর পর ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার ও ২০০১ সালে জোটগতভাবে নির্বাচন করে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।খালেদা জিয়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) দুবার চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার একটি অনন্য রেকর্ড হচ্ছে- পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে ২৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতেই তিনিই জয়ী হয়েছেন।
সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর তিনি আইনি লড়াই করে সব কটি মামলায় জামিন নিয়ে মুক্তিপান। কারাগারে থাকাকালে তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি যেতে অস্বীকার করেন।আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হন। খালেদা জিয়ার অভিযোগ, বলপ্রয়োগে তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তিনি ওই বাড়িটিতে ২৮ বছর ছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার সেনানিবাসের বাড়িটি তার নামে বরাদ্দ দিয়েছিলেন।এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হয়ে পরের বছর ১১ সেপ্টেম্বর তিনি হাইকোর্টের আদেশে মুক্তিপান।
বেগম খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতালে এ ভর্তি হয়েছিলেন। দেশে কোভিডের বিস্তার আবার বেড়ে যাওয়ায় এভারকেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তিনি গুলশানের বাসায় ফিরছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় গত ৯ জানুয়ারি তাঁকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে কেবিনে নেওয়া হয়৷ গত ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়া ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ শাহাবুদ্দিন তালুকদারের অধীন ভর্তি হন৷ তাঁর চিকিৎসায় ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়৷
৭৬ বছর বয়সি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বুহুদিন থেকে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন৷ সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার ‘পরিপাকতন্ত্রে’ রক্তক্ষরণ এবং লিভার সিরোসিসে ভুগছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মিথ্যা বানোয়াট মামলায় ফরমায়েশি রায়ে ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে ছিলেন খালেদা জিয়া।
দেশে করোনা মহামারি দেখা দিলে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ দুই শর্তে সরকারের নির্বাহী আদেশে ৬ মাসের জন্য মুক্তি পান খালেদা জিয়া। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার উপধারা ১-এ সাজা স্থগিত দেখিয়ে এ পর্যন্ত কয়েক দফায় এ মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
পদক ও সম্মাননা
২০১১ সালের ২৪ শে মে নিউ জার্সি স্টেট সিনেটে তাকে ’ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি’ পদক প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সিনেট কর্তৃক কোন বিদেশিকে এ ধরনের সম্মান প্রদানের ঘটনা এটাই ছিল প্রথম।
‘গণতন্ত্র রক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য খালেদা জিয়াকে ৩১ জুলাই ২০১৮ ইংরেজি ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি ’ সম্মাননা দিয়েছে কানাডার মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও)।’
বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ইংরেজি ‘দি কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন’ এর পক্ষ থেকে ‘ডেমোক্রেসি হিরো’ সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট প্রদান করেছেন।
লেখকঃ আব্দুল আজিজ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট