ওষুধনামা : মাসুমা সিদ্দিকা
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
রবিবার, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২২ ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
রবিবার, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২২ ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ
ধরা যাক, আপনি ঠাণ্ডা মাথায় বা উত্তেজনাবশত একজন মানুষকে খুন করে ফেললেন, তার জন্য কঠোর শাস্তি হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। অথচ ভেজাল ওষুধের মাধ্যমে আপনি যদি অনেক মানুষের মৃত্যু বা বিকলঙ্গতা বা গুরুতর অসুস্থতার কারণ হন, এর জন্য এ দেশে আপনার শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বর্তমানে মানুষের জীবন সংহারক হিসেবে উপস্থিত হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। যে ওষুধের ওপর আমরা নির্ভর করি জীবন রক্ষার জন্য তা যদি অসাধু ব্যবসায়ীদের লোভ-লালসার শিকারে পরিণত হয় ও জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়– তবে তো সেটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
আজকাল অনেক জায়গাতেই আমরা ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের কথা শুনতে পাই। আবার যখন কোনও মহামারির মতো অবস্থা তৈরি হয় তখন অসাধু ব্যবসায়ীদের যোগ সাজশে সেই ওষুধগুলোর ক্ষেত্রে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা আর সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে পড়ে নিরাপত্তাহীন, অসহায়। এসব ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারায় দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
অতি প্রাচীনকাল থেকে মানুষ যখন কোনও অসুখে পড়তো তারা তখন গাছের বিভিন্ন লতা-পাতা-বাকল ইত্যাদির রস খেয়ে, ব্যবহার করে উপশম পেত। কিন্তু সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই জীবনরক্ষাকারী গাছ- লতা-পাতা ইত্যাদি দিয়ে মানুষ সহজলভ্য ওষুধ তৈরি করে ফেলেছে। আমরা প্রয়োজনে বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে টাকার বিনিময়ে সহজেই তা পেয়ে থাকি। যদিও এই সহজলভ্যতা নিয়েও প্রেসক্রিপশন ওষুধের অপব্যবহারের এক জটিলতা রয়েছে।
বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি আমাদের জন্য সহজলভ্য করেছে মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে। আজ আমাদের দেশের প্রস্তুত করা ওষুধ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে এবং দেশের জন্য সুনাম নিয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে দেশে ভেজাল ওষুধের ব্যবহার শুধু মানুষের প্রাণহানিই নয় আমাদের এই সুনাম নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।
ওষুধের দোকান বা ফার্মেসি খোলার জন্য লাইসেন্স নিতে হয় তা সবাই জানি কিন্তু এখন অনেক জায়গাতেই এমনকি ফুটপাতেও ওষুধ বিক্রি হতে দেখা যায়, যেগুলোর কোনও লাইসেন্স থাকে না। তারা লাইসেন্স বিহীন দোকান নিয়ে বিক্রি করছে ওষুধ। অনেকক্ষেত্রে আবার ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও বিক্রি করতে দেখা যায়। দেশে যখন ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান চালায় তখন প্রচুর পরিমাণ ভেজাল ওষুধ দেখতে পাওয়া যায়।
এমনকি সম্প্রতি রাজধানীর কিছু কিছু অভিজাত ফার্মেসিতেই মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়ায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কিছু সংখ্যক কর্মচারীকে গ্রেফতার করেন। আবার অনেকে ওষুধের লেবেল নিজেরা বানিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ হবার তারিখ নিজেদের পছন্দমতো বসিয়ে দেন। এতে করে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সেবনে রোগী সুস্থ হবার বদলে অসুস্থ হয়ে পড়েন, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ তখন জীবন নাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আবার এমনও দেখা যায় যে, একই ওষুধ বিভিন্ন দোকানে স্থান ভেদে বিভিন্ন মূল্যে বিক্রি হয়। বিশেষ করে মরণাপন্ন রোগীদের উচ্চ মূল্যের ওষুধের ক্ষেত্রে কোনও জায়গায় কিছু কম দামে আবার অন্য জায়গায় অনেক চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। আর মানুষজন সব জায়গায় দর কষাকষি করলেও এই একটি জায়গায় সহজে দর কষাকষি করতে পারেন না বলে এই সুযোগ নেন ব্যবসায়ীরা। সব ওষুধের পাতায় কোনও মূল্য লেখা থাকে না বলে অনেক বিক্রেতাই এই সুযোগটা নিয়ে নেন। আবার বিশেষ কোনও উপসর্গের জন্য যে নির্দিষ্ট ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয় তার কোম্পানিভেদেও বিভিন্ন মূল্যের হয়ে থাকে। মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে কোনও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় প্রতিনিয়ত মানুষ প্রতারিত হচ্ছে সঠিক মূল্য থেকে।
যখন কোনও মহামারি দেশে হয় তখন মানুষ নিরুপায় হয়ে যায় সেই বিশেষ ওষুধ ছাড়া আর সেই সুযোগে লোভী বিক্রেতারাও সেসব ওষুধের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে অল্প মূল্যের ওষুধগুলো চড়া দামে বিক্রি করেন। আর অসহায় মানুষ নিরুপায় হয়েই চড়া দামে সেসব কিনতে বাধ্য হন।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু যখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তখন কয়েকদিনের মধ্যেই মশার বিভিন্ন প্রতিরোধক ক্রিমগুলো বাজার থেকে প্রায় উধাও হচ্ছিল বা অনেক গুণ দামে বিক্রি হচ্ছিল। কয়েকদিন পরে আবার সেসব দেখতেও পেয়েছি বিভিন্ন ফার্মেসিতে কিন্তু স্বাভাবিক মূল্যে নয়, গায়ে লেখা দামের থেকে ৫-৬ গুণ বেশি দামে এবং সেসবের কোনও রশিদও বিক্রেতারা দিতে নারাজ ছিলেন।
অসাধু ব্যবসায়ীদের লোভ লালসার শিকার হয়ে অসহায় মানুষকেই প্রতিনিয়ত মূল্য দিতে হয়। কিছু কিছু অভিযান চললেও, কিছু জরিমানা করলেও এদের লাগাম যেন টেনে রাখা সম্ভব হয় না। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রির ব্যাপারে যে আইন আছে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ দেওয়া যাবে না সেটাও তারা মানেন না। নিজেরাই ডাক্তারী বিদ্যা ফলিয়ে রোগীদের যখন তখন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন।
ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ মৃত্যুর মুখে। ক্যানসার, হৃদরোগ সহ বহু জটিল- আইসিইউ, সিসিইউ রোগীদের ক্ষেত্রে এই ভেজাল ওষুধগুলো ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনে বলে অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে এই মৃত্যুগুলোর জন্য কেন মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি প্রাপ্য হবে না তা আমরা বুঝতে পারি না। যদি এই মৃত্যুগুলোর জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা যেত, নিয়মিত অভিযান চালানোর ব্যাপারে, ভেজাল- মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ব্যাপারে, লাইসেন্স বিহীন ফার্মেসিগুলোর ক্ষেত্রে তবে এত মানুষ আজ মৃত্যুমুখে পতিত হতো না। ওষুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন, বাজার মূল্য সব ক্ষেত্রেই সরকারের কঠোর সুদৃষ্টি কামনা করি। যদি পুরোপুরি এ ব্যাপারে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন নাও করা যায়, অন্তত সরকার যে ওষুধগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে নির্ধারণ করেছে সেগুলোর ব্যাপারে কঠোর নজরদারী প্রয়োজন।
এমনকি সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর যে ৬টি জেলার ওষুধের মান পরীক্ষার লক্ষ্যে মিনি ল্যাব স্থাপন করেছে তাতেও অবস্থার কোনও গুণগত পরিবর্তন দেখা যায় না। দেশের একমাত্র সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি হিসেবে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানিকেও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরিতে তেমনভাবে ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানে সরকারের আরও বিনিয়োগ করা উচিত। তারা যেন অধিকতর গবেষণা করে সুলভ মূল্যে ওষুধ তৈরি এবং সরবরাহে আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করলে হয়ত অনেক মানুষের ওষুধ প্রাপ্তির সুযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই বর্তমান বাস্তবতায় অন্তত ভেজাল এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
লেখক: রন্ধন শিল্পী ও ফ্রিল্যান্সার
masumasiddika.com