কর্মস্থলে মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস, ক্ষতিপূরণে ফাঁপা আশ্বাস
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
মঙ্গলবার, জুন ৭, ২০২২ ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
মঙ্গলবার, জুন ৭, ২০২২ ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৪ তারিখ, সকাল সাড়ে ১০টা। মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে শেষ কথা হয় হাবিবুরের। কথার ফাঁকে পরিবারের খোঁজ-খবর নেন হাবিব। জানান চার দিনের ছুটে পেয়েছেন। এখন অপেক্ষা বেতনের। ৩/৪ দিনের মধ্যে বেতন পেলেই বাড়িতে আসবেন। আবার ছুটি শেষে প্রিয় কর্মস্থলে ফিরে যাবেন। হাবিবের ইচ্ছা ছিলো ছোট বোনকে ডাক্তারি পড়ানো। কিন্তু তার নিয়তি ঠিক করেছিল মায়ের কোলে ফিরবে। তবে জীবিত নয়, নিথর দেহে…।
ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়ে নানা বাড়িতে আশ্রয় হয় হাবিবের। ৭ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমান চট্টগ্রামে। সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি নেন। প্রতিদিনের মতো ঘটনার দিন ডিউটি পালন করছিলেন তিনি। ওই রাতেই ভয়াবহ বিস্ফোরণে অন্য সকলের সাথে প্রাণ যায় হাবিবুরের। তিনি ছিলেন তাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। এ মৃত্যুতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের পরিবারের আয়ের পথ।
শনিবার রাতে লাগা আগুন ও বিস্ফোরণে শেষ পর্যন্ত ৪১ জন নিহত হবার খবর নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৩ হয়েছে।
এদিকে জীবিকার সন্ধানে এসে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থলে প্রাণ হারাচ্ছেন শত শত শ্রমিক। কোনোভাবেই থামছে না এই মৃত্যুর মিছিল। সাভারে তাজরিন গার্মেন্ট ও রানা প্লাজা ধস, পুরান ঢাকার নিমতলী-চুড়িহাট্টা, সেজান জুস কারখানা অগ্নিকাণ্ডের পর ডিপো বিস্ফোরণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। কোথাও পুড়ে, কোথাও চাপা পড়ে কর্মস্থলেই নির্মম মৃত্যু হচ্ছে শ্রমিকের। প্রতিটি ঘটনায় পর্দার অন্তরালে থেকে যাচ্ছে প্রকৃত দোষীরা।
অভিযোগ রয়েছে, মালিকদের কম ব্যয়ে বেশি মুনাফা লাভের মানসিকতা দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ। এছাড়া সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নামমাত্র যাচাই বাছাই করে এসব প্রতিষ্ঠাকে লাইসেন্স প্রদান করে। আর দুর্ঘটনায় সরকারি সংস্থাগুলোকে দায় নিতে হবে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের।
এদিকে কলকারখানা মালিকরা বলছেন, কোনো কারখানার ভবন তৈরি হয় প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে বিল্ডিং কোড অথরিটির অনুমোদন নিয়ে। এরপর বিস্ফোরক অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডাইফি), পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ মোট ১৬/১৭ টি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের পরই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা হয়।
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারায় ১২৪ জন। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের তাজরিন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় ১১৭ টি তাজা প্রাণ। পরের বছরে ধসে পড়ে সাভারের আরেক বৃহৎ পোশাক কারখানা রানা প্লাজা, যেখানে প্রাণ হারায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় প্রাণ হারায় ৭১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ। সর্বশেষ গত ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক জরিপ তথ্যে জানা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক হাজারের মতো শ্রমিক মারা যাচ্ছে কর্মস্থলে কর্মরত অবস্থায়। সংস্থাটি ২০২০ সালে যে জরিপ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২০ সালে কর্মস্থলে জীবন দিতে হয়েছে ৭২৯ জন শ্রমিককে। এরমধ্যে ৭২৩ জন পুরুষ এবং ৬ জন নারী শ্রমিক। খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ৩৪৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষি খাতে।
বিলসের তথ্য মতে, ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন খাতে ১ হাজার ২০০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়, এরমধ্যে ১ হাজার ১৯৩ জন ছিল পুরুষ এবং ৭ জন নারী শ্রমিক। খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটে পরিবহন খাতে ৫১৬ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে নির্মাণ খাতে ১৩৪ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে কৃষি খাতে ১১৬ জন। সুতরাং সংখ্যাগত দিক থেকে ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে কর্মস্থলে শ্রমিকের মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে।
বিলসের পরিসংখ্যানে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৪৩৩ জন শ্রমিক আহত হয়, এরমধ্যে ৩৮৭ জন পুরুষ এবং ৪৬ জন নারী শ্রমিক। মৎস্য খাতে সর্বোচ্চ ৬৮ জন শ্রমিক আহত হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নির্মাণ খাতে ৪৯ জন শ্রমিক আহত হন।
এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ৪৮, পরিবহন খাতে ৪৭, জুতা কারখানায় ২০ জন, নৌপরিবহন খাতে ১৬, তৈরি পোশাক শিল্পে ৩৭, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে ২৯, দিনমজুর ১৬, উৎপাদন শিল্পে ১৯, স্টিল মিলে ১৯, কৃষিতে ১০ জন শ্রমিক আহত হন। এছাড়া অন্যান্য খাতে ৪০ জন শ্রমিক আহত হন।
বিলসের জরিপ তথ্যে উল্লেখ করা হয়, বিগত ১০ বছরে কর্মস্থলে সর্বোচ্চ শ্রমিক মৃত্যু পরিবহন এবং নির্মাণ সেক্টরে। ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, পরিবহন সেক্টরে ২০২০ সালে ৩৪৮ জন শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটে, যা পূর্ববর্তী দুই বছরের তুলনায় কম। নির্মাণ খাতে ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৮৪ জন শ্রমিক নিহত হন, যা ২০১৯ সালে ছিল ১৩৪ জন এবং ২০১৮ সালে ছিল ১৬১ জন।
স্বাধীন খবর ডটকম/আ আ
