খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি’র নেতৃত্বে মনা-তুহিন ও এজাজ-বাপ্পী
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
মঙ্গলবার, মার্চ ১, ২০২২ ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
মঙ্গলবার, মার্চ ১, ২০২২ ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ
সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
দীর্ঘ ২৭ বছর পর খুলনা মহানগর বিএনপি’র নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়েছেন নেতাকর্মীদের কাছে দুর্দিনের কাণ্ডারি বলে খ্যাত নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি। মহানগর ও জেলা শাখার নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হলেও খুলনা বিএনপি’র শীর্ষ এই দুই নেতাকে কোথাও রাখা হয়নি। ফলে তাদের অনুসারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। অপরদিকে, দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি করে আসা অপর অংশের মধ্যে উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে।
এর আগে খুলনা জেলা ও মহানগর বিএনপি’র কমিটি ভেঙে দিয়ে আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ৯ই ডিসেম্বর এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, এডভোকেট এসএম শফিকুল আলম মনাকে আহ্বায়ক, তরিকুল ইসলাম জহিরকে ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক ও মো. শফিকুল আলম তুহিনকে সদস্য সচিব করে খুলনা মহানগর বিএনপি’র আংশিক আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদিত হয়েছে। যদিও এ কমিটির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা জেলার রাজনীতির সঙ্গেই ছিলেন। তিনি জেলা বিএনপি’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।
অপরদিকে আমির এজাজ খানকে আহ্বায়ক, আবু হোসেন বাবুকে ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক ও মনিরুল হাসান বাপ্পিকে সদস্য সচিব করে খুলনা জেলা বিএনপি’র আংশিক আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদিত হয়েছে।
এ কমিটির আহ্বায়ক আমির এজাজ খান জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
এদিকে মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেউ এ কমিটিতে স্থান না পেলেও জেলা বিএনপি’র সভাপতি এডভোকেট এস এম শফিকুল আলম মনা ও সাধারণ সম্পাদক আমীর এজাজ খান রয়েছেন মহানগর ও জেলা বিএনপি’র মূল নেতৃত্বে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে চলা কমিটি ভেঙে দেয়ার গুঞ্জনের মধ্যে হঠাৎ করেই খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি’র কমিটি ভেঙে আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার মধ্যদিয়ে দীর্ঘদিন পর খুলনা বিএনপিতে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর একক নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে গেছে। তবে নজরুল ইসলাম মঞ্জু মহানগর বিএনপি’র সভাপতির পদ থেকে বাদ পড়লেও তিনি কেন্দ্রীয় বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর খুলনা মহানগর বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও আলী আজগর লবী অনুসারীদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। ওই সময় প্রবীণ নেতা এম নূরুল ইসলাম দাদুভাই মহানগর বিএনপি’র সভাপতি ও নজরুল ইসলাম মঞ্জু সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে আলী আজগর লবীকে মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক করা হলে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। তবে ওয়ান-ইলেভেনের সময় আলী আজগর লবী মামলায় অভিযুক্ত হলে তার অনুসারীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এরপর আর খুলনার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারেননি তিনি। লবীর অবর্তমানে তার অনুসারীদের অধিকাংশ নজরুল ইসলামের সঙ্গে হাত মেলান।
এই সূত্র মতে, খুলনা বিএনপি’র কোন্দল দীর্ঘদিনের। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন সিটি মেয়র শেখ তৈয়েবুর রহমান ও আলী আসগর লবী দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার হন। এরপর তাদের অনুসারীরা রাজনীতির মাঠ থেকে ছিটকে পড়েন।
অপরদিকে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের প্রকাশ্যে সমালোচনা করার কারণে ‘সংস্কারপন্থি’ বলে চিহ্নিত দলের তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব শেখ আশরাফ হোসেনকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর থেকে মূলত নজরুল ইসলাম মঞ্জু খুলনা বিএনপি’র রাজনীতি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। ২০১৬ সালে বিএনপি’র গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে একাধিক পদের জায়গায় ‘একটি পদ’ রেখে বাকি পদ ছেড়ে দিতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেয়া হয়। তখন থেকেই মহানগর বিএনপি’র সাবেক সভাপতি আলী আসগর লবীর অনুসারীরা ‘মহানগর বিএনপি’র সভাপতির পদ’ থেকে মঞ্জুকে হঠানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হন। গত সেপ্টেম্বরে মহানগর বিএনপি’র সহ-সভাপতি সাহারুজ্জামান মোর্তজার নেতৃত্বে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রতিপক্ষ গ্রুপ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে দেখা করেন। এরপরই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি’র কমিটি ভেঙে দেয়ার। যার সর্বশেষ নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার মধ্যদিয়ে প্রকাশ্যে আসলো। নতুন আহ্বায়ক কমিটি সম্পর্কে জানতে মহানগর বিএনপি’র সদ্য সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ফোন রিসিভ করেননি। সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। এ ছাড়া মঞ্জু-মনির ঘনিষ্ঠ বিএনপি’র একাধিক নেতাকে ফোন দিলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। তবে মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, দল ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে দায়িত্ব দেবেন, আমি সেই দায়িত্বই পালন করবো। আমাকে আহ্বায়কের পদ না দিলেও তাতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। তবে এ মুহূর্তে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে ঐক্যবদ্ধভাবে দল ও গণতন্ত্রের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো। এ জন্য আমরা চাই খুলনা বিএনপিকে আরও ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত করতে।
খুলনা জেলা বিএনপি’র নতুন আহ্বায়ক আমির এজাজ খান বলেন, কমিটির বিষয়টি তিনি অবহিত হয়েছেন। দল যে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেটি তিনি যথাসাধ্য পালনের চেষ্টা করবেন বলে জানান।
এর আগে ২০০৯ সালের ২৫শে নভেম্বর খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে নগর বিএনপি’র সর্বশেষ সম্মেলনে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে সভাপতি ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনিকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে খুলনায় বিএনপি’র নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু। কয়েকবার সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করলেও মহামারি করোনাসহ নানান প্রতিবন্ধকতায় হয়নি নগর বিএনপি’র সম্মেলন।
তবে ২০১৭ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি এডভোকেট শফিকুল আলম মনাকে সভাপতি ও আমীর এজাজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করে আংশিক কমিটি ঘোষণা দেয় কেন্দ্র। তখন সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম মনিরুল হাসান বাপ্পীর নেতৃত্বে একটি অংশ এ কমিটির বিরোধীতায় কুশপুত্তলিকাদাহসহ আন্দোলনও করেছিল। এর আগে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে অধ্যাপক মাজিদুল ইসলামকে সভাপতি, এডভোকেট শফিকুল আলম মনাকে সাধারণ সম্পাদক ও আমীর এজাজ খানকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৫ সদস্যের আংশিক জেলা বিএনপি’র কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল।
এদিকে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি’র আংশিক কমিটি ঘোষণার পর কে ডি ঘোষ রোডস্থ দলীয় কার্যালয়ে আসেন নবনেতৃবৃন্দ। আগেই সেখানে নগরীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড বিএনপি এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের শত শত নেতা-কর্মী উপস্থিত হন। বৈরী আবহাওয়া ও লাগাতার বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষায় থাকেন তারা। ৭টার দিকে নতুন কমিটির নেতারা কার্যালয়ে এসে হাজির হলে করতালি ও স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরও এলাকা। এ সময় বক্তৃতা করেন মহানগর আহ্বায়ক এডভোকেট শফিকুল আলম মনা, জেলা আহ্বায়ক আমির এজাজ খান, মহানগর সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন, প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম জহির ও জেলা সদস্য সচিব এস এম মনিরুল হাসান বাপ্পী।
কর্মীদের উদ্দেশ্যে তারা বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য গুরুতর অসুস্থ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানো নিশ্চিত করতে সরকারকে বাধ্য করা। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় খুলনা বিএনপি আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছাত্রদল, যুবদল নবীণ ও তরুণ নেতৃত্ব রয়েছে। তারা রাজপথের আন্দোলনে যে কোনো আত্মত্যাগে প্রস্তুত। এই ঐক্যকে ধরে রেখে দলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং আগামীর আন্দোলনে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে হবে। জনগণের ভোট ও মতপ্রকাশের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে।
নব ঘোষিত কমিটির মাধ্যমে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে উল্লেখ করে নেতারা বলেন, সবাইকে নিয়ে আমরা আগামীর পথ চলবো। নতুন কমিটি ঘোষণা করায় বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তারা। বক্তৃতা শেষে অসুস্থ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি ও দীর্ঘায়ু কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। দেশনেত্রীর গুরুতর অসুস্থতা ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এ সময় ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময় বা মিষ্টিমুখ পর্ব হয়নি।
খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি’র প্রথম সভা শনিবার: খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি’র নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দলীয় কার্যালয়ে মিলিত হয়েছেন। সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়ে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করেন তারা। নবঘোষিত কমিটির প্রথম কর্মসূচি আজ বেলা ১১টায় দলীয় কার্যালয়ে যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ সভায় দলের সকল অঙ্গ-সংগঠনের জেলা ও নগর শাখার নির্বাহী কমিটিকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। নগর বিএনপি’র সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন আজ সভার আলোচ্য সূচি নির্ধারণ করেছেন। বুদ্ধিজীবী দিবস পালন, বিজয় দিবসের কর্মসূচি ও ২০শে ডিসেম্বর বেলা ১১টায় জেলা পর্যায়ের সমাবেশ সফল সম্পর্কে করণীয়। তিনি জানান, সন্ধ্যার পর থেকে নয়া কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। সকল স্তরের নেতাকর্মীরা নয়া কমিটিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নেয়া অনুমতি আন্দোলন বেগবান করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানিয়েছেন। সন্ধ্যার পর নেতৃবৃন্দ দলীয় কার্যালয়ে কর্মীদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। নগর বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম জহিরের পরিচালনায় বেগম খালেদা জিয়ার আশু সুস্থতা কামনা ও দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।