• আজ সকাল ৭:৪৬, বুধবার, ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি
  • shadinkhobor24@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক ও কিছু মিথ্যাচারের জবাব

নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ: বুধবার, মার্চ ২৩, ২০২২ ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ: বুধবার, মার্চ ২৩, ২০২২ ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ

 

সীমিতসংখ্যক বিরোধীদের বাদ দিলে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সব অংশগ্রহণের গৌরবগাথা অভিন্ন নয়, নয় ব্যক্তি অবস্থান সমান্তরাল। এই অবস্থানগত ভিন্নতা স্বাধীনতার পর যুদ্ধে ব্যক্তির ভূমিকার প্রশ্নে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই বিতর্কের মূল কেন্দ্রে অবস্থান করছেন দুই ব্যক্তি, একজন রাজনীতিবিদ এবং অন্যজন সমরনায়ক ও রাজনীতিবিদ।

কে এই সমরনায়ক? এ প্রশ্নের জবাব জিয়াউর রহমান। কিন্তু এ জবাব যথেষ্ট নয়। গত প্রায় এক বছর ধরে এই জিয়াউর রহমান সম্পর্কে অনাকাঙ্ক্ষিত, অশালীন বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে , কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বীরউত্তম খেতাব এবং বক্তব্য বিবৃতি ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন মন্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সর্বশেষ এই অশালীন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। তাদের একজন মন্তব্য করেছেন জিয়াউর রহমান সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না। তাহলে কে এই জিয়াউর রহমান? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান কি কোনো ভৌতিক উপস্থিতি? কেনই বা তাঁকে নিয়ে এই মিথ্যাচার? শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে অথবা আদালতের রায় ব্যবহার করে জিয়াউর রহমানকে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১১ এপ্রিল জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বেতার ভাষণে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের যোদ্ধ পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমানবাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার ভাই-বোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবলমুক্ত রয়েছে।’ তাজউদ্দীন আহমদ নিশ্চয়ই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেননি এবং জিয়াউর রহমানের অযথা প্রশংসা করার মতো তাঁর কাছে এ ছাড়া অন্য কোনো কারণ ছিল না। বর্তমানের একজন প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক জিয়াকে পাকিস্তানের চর হিসেবে আখ্যায়িত করা আর তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য, কোনটি সঠিক। তাজউদ্দিন আহমদ কি অসত্য ভাষণ করেছিলেন?

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর আগ্রাসনকে ঠেকানোর জন্য সোভিয়েত বাহিনী ১৯৪২ সালের ১৭ থেকে ১৮ নভেম্বর ভলগোগ্রাড শহরে এক অসম সাহসিকতায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর ১৯ নভেম্বর সোভিয়েত নেতা মার্শাল স্টালিনের নেতৃত্বে মার্শাল জুকভ যে আক্রমণ পরিচালনা করেন, তার পরিণতিতে জার্মান বাহিনী ৮ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য হারিয়ে ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করে। সোভিয়েত পক্ষে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য। এই যুদ্ধে বিজয়ের জন্য স্টালিনের রণনীতি ও রণকৌশলের সফল প্রয়োগকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় এবং পরিণতিতে ভলগোগ্রাডের নামকরণ করা হয় স্টালিনগ্রাড। তাজউদ্দীন আহমদ এসব ইতিহাস জানতেন বলে তুলনা করার গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করতে এবং বুঝতে পারতেন।

যুদ্ধ শুরু করার দিনগুলোতে কে, কীভাবে ঘোষণা করেছেন সে সম্পর্কেও প্রচুর বিতর্ক হচ্ছে। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ কলকাতা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর মন্তব্য করেছে, ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধান মেজর জিয়া আজ ঘোষণা করেন যে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ স্থান এখন তাঁর মুক্তি ফৌজের দখলে রয়েছে। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো তথা বিশ্ববাসীকে তা দেখে যাওয়ার জন্য তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’ ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল কলকাতার আনন্দবাজার লিখেছে, ‘বাংলাদেশের তিন সেনাপতি : বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা ও শহর ছাড়া প্রায় সবটাই এখন মুক্তি ফৌজের দখলে। এই প্রশাসনে তিনটি সেক্টরের নেতৃত্ব করছেন তিনজন সেনাপতি। তারাই মিলিতভাবে মুক্তি ফৌজের নিয়ন্ত্রণ করছেন। আওয়ামী লীগের অনুগত সামরিক অফিসার ও কর্মচারীরা তাদের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করছেন। এই তিন সেনাপতিরা হলেন মেজর খালেদ মুশাররফ (শ্রীহট্ট সেক্টর), মেজর সফিউল্লা (ময়মনসিংহ) ও মেজর জিয়াউর রহমান (চট্টগ্রাম)। জিয়াউর রহমানই মেজর জিয়া নামে অস্থায়ী সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেছিলেন।’

কিন্তু ঘোষণাটা কেমন করে হয়েছিল? স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইপিআরে কর্মরত মোঃ আশরাফ আলী সরদার বলেছেন, ঢাকায় অবস্থিত সিগনালের প্রধান বেতার কেন্দ্র রাত ১২টার সময় বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়ার আগে বাংলাদেশের সব ইপিআর বেতার কেন্দ্রে খবর পৌঁছে দেয়া হয় যে, উইং কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রহমান আওয়ান ‘আমাদের নির্দেশ দিচ্ছে সব বেতার যোগাযোগ বন্ধ রাখার জন্য।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘২৬ মার্চ সকাল ১০টা পর্যন্ত আমাদের এইচএফ চালু থাকে, যার মাধ্যমে ২৫ মার্চের ঘটনা নায়েক শহীদ বাশার বাইরের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর শেষ সংবাদে চট্টগ্রামকে বলেছিলেন যে, আমাদের সবাই বন্দি হয়ে গেছে । হয়তো কিছুক্ষণ পর আমিও বন্দি হয়ে যাব এবং আর নির্দেশ দেয়ার সময় পাব ন। তোমরা সব পশ্চিমাদের খতম কর। চট্টগ্রাম থেকে হাবিলদার বাহার ওই সংবাদ সীমান্তের চৌকি পর্যন্ত পৌঁছে দেয় এবং আমাদের লোকজনকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সে বলেছে, ‘আমি ঢাকা থেকে বলছি। সম্পূর্ণ ঢাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে এসেছে এবং ইপিআরের ডিরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার নেসার আহমদ বন্দি হয়েছেন। তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড় এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের বন্দি করে আমাকে রিপোর্ট দাও।’ দেখা যাচ্ছে, এই বার্তার সঙ্গে অন্য কারও নাম যুক্ত নেই এবং ব্যক্তির আবেগেই বার্তার ভাষা পরিবর্তিত হয়েছে।

মেজর জিয়ার ঘোষণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রম মাসিক গণমন পত্রিকায় ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘২৭ শে মার্চ রাত্রে সর্ব প্রথম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর ঘোষিত হলো, আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি।’

মার্চ মাসে বিশেষ করে ২৫ মার্চ ও তৎপরবর্তী সময়ে ঢাকা সেনানিবাস ও শহরে যা ঘটেছিল, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে ক্যাপ্টেন পদে ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত আবু তাহের সালাউদ্দীন বলেন, ‘ইতিপূর্বে সন্ধ্যা ৭টার সময় ক্যাপ্টেন এনামের কক্ষে রেডিওতে আমরা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমানের ভাষণ শুনতে পাই।

বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘এই বিরাট শক্তির মোকাবিলায় বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হবে না—এ কথা বাঙালি সৈন্যরা বুঝেছিলেন। তাই শহর ছেড়ে যাওয়ার আগেই বিশ্ববাসীর কাছে কথা জানিয়ে যাওয়ার জন্য মেজর জিয়া ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা মেজর জিয়াকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। কিন্তু কী বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিঁড়ে ফেলেন। কী জানাবেন তিনি বিশ্ববাসী এবং দেশবাসীকে বেতার মারফত? এদিকে বেতারকর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন—আর ১৫ মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু ১৫ মিনিট পার হয়ে গেল। মেজর জিয়া মাত্র তিন লাইন লিখতে পেরেছেন। তখন তাঁর মানসিক অবস্থা বুঝার নয়। লেখার ঝুঁকিও ছিল অনেক। ভাবতে হচ্ছিল শব্দ চয়ন, বক্তব্য পেশ প্রভৃতি নিয়ে। প্রায় দেড় ঘণ্টা মুসাবিদার পর তিনি তৈরি করেন তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি। নিজেই সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করেন।’

২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজ নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা সারা দেশে এবং বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। পরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ আবারো স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তৎকালীন কর্নেল জিয়াউর রহমানের লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি তার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বহির্নোঙরে থাকা একটি জাপানি জাহাজে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা রেকর্ড করা হয়, যা পরবর্তীতে রেডিও অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক সংগৃহীত হয় এবং সারা বিশ্ব তা শুনতে পায়। এ ছাড়া আগরতলা থেকে মনিটরকৃত এ ঘোষণা ইন্ডিয়া নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

(Dear fellow freedom fighters, I, Major Ziaur Rahman, Provisional President and Commander-in-Chief of Liberation Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle, Bangladesh is independent. We have waged war for liberation war with whatever we have. We will have to fight and liberate the country from occupation of Pakistan Army. Inshallah, victory is ours.)

অনুবাদ: আমি,মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমাণ্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সকল জাতীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এৰং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জিয়াউর রহমান নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে ছিলেন না। পুরো যুদ্ধের সময়, প্রথম দিকে তিনি ছিলেন সেক্টর কমান্ডার ও পরবর্তী সময়ে জেড ফোর্সের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম জেলা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার পুরো পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত সেক্টর ১-এর কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত। এরপর এ দায়িত্ব পান মেজর রফিকুল ইসলাম। খালেদ মোশাররফ এবং শফিউল্লাহ উভয়েই যুদ্ধের প্রথম কয়েক মাস সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে এরা কে ফোর্স এবং এস ফোর্সের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অথচ অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল হারুন ৯ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত মন্তব্যে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে জিয়াউর রহমান ছিলেন এরিয়া কমান্ডার। পরে তিনি ফোর্স কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কখনও সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না।’ সত্যের এক অদ্ভুত অপলাপ। ১৯৭২ সালের ৪ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সব মুক্তিযোদ্ধার প্রধান জেনারেল ওসমানী বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে আমি ১১টি সেক্টরে ভাগ করেছিলাম। ১১টি সেক্টর একেকজন অধিনায়কের অধীনে ছিল এবং প্রত্যেক অধিনায়কের একটি সেক্টর হেড কোয়ার্টার ছিল। … যখন বাংলাদেশ সরকার আমাকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করেন, তখন আমি তাদের অনুমোদনক্রমে লে. কর্নেল (বর্তমানে মেজর জেনারেল) এম এ রবকে চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করি। তিনি আমার পরে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন। তিনি গণপরিষদেরও সদস্য। বিভিন্ন সেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করি : এক নম্বর সেক্টরে প্রথম মেজর (বর্তমানে কর্নেল) জিয়াউর রহমান, পরে মেজর রফিক।’ জেনারেল ওসমানীর এই বক্তব্যের সমর্থন রয়েছে জেনারেল সফিউল্লাহর বক্তব্যে, যিনি ছিলেন তিন নং সেক্টরের কমান্ডার, এস ফোর্সের কমান্ডার এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সদস্য মেজর রফিকুল ইসলাম বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না। ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত কলকাতায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বরাত দিয়ে তিনি তার লেখা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে (১৯৮১) গ্রন্থে সভায় উপস্থিতদের যে নামের তালিকা দিয়েছেন, তাতে মেজর জিয়াউর রহমানের নাম আছে। কিন্তু পরের পৃষ্ঠায় বিভিন্ন জনের দায়িত্ব বণ্টনের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে কোনো পদবি অনুযায়ীই জিয়াউর রহমানের নাম নেই। ইতিহাসের এত নগ্ন বিকৃতি বাংলাদেশেই সম্ভব।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত কিছু রেফারেন্স নিম্নে তুলে ধরা হলো- ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দিল্লিতে দেয়া এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় বলেছিলেন, ‘জনাব রাষ্ট্রপতি, আপনার অবস্থান ইতোমধ্যে দেশের ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০২ সালের ১৩ মার্চ তারিখে ‘দি নিউ ন্যাশন’ পত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণাও করেননি বা কারো হাতে কোনো লিখিত দলিল হস্তান্তর করেননি।’

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম তার ‘স্বাধীনতা-৭১’ শীর্ষক বইয়ের ৪১৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এই রকম ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’

মেজর জেনারেল (অব:) সুবিদ আলী ভূঁইয়া ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তার ‘মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস’ শীর্ষক বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘বেতার কেন্দ্র থেকে যারা মেজর জিয়ার ভাষণ শুনেছিলেন তাদের নিশ্চয় মনে আছে, মেজর জিয়া তার প্রথম দিনের ভাষণে নিজেকে ‘হেড অব দি স্টেট’ অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান রূপেই ঘোষণা করেছিলেন।’

ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন ‘রেডিও সেটে ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে ‘স্বাধীন বাংলা রেডিও’র ঘোষণা শুনিতে পাই। এই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হয়েছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিন দিশেহারা, হতভম্ব ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালি জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ।’

ভারতের সাংবাদিক জ্যোতি সেনগুপ্ত তার ‘হিস্টরি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন ‘মেজর জিয়া ও তার বাহিনী ২৬ মার্চ ভোর রাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ওই দিন সন্ধ্যায় বেতারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিজের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন।’

বিখ্যাত লেখক ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছিলেন ‘২৭ মার্চ শনিবার রাত ৮টায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভুত একটা ঘোষণা শুনতে পায় মেজর জিয়া নামের কেউ একজন নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন- ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ বলে তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন। দেশের মানুষের ভেতর দিয়ে তীব্র ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়।’

এ ছাড়া এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) এ কে খন্দকার বীর উত্তমসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বইয়েও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে কেবলমাত্র জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথের সময় ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতি দান করেন।

মেজর জিয়াউর রহমান শুধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে ১ নম্বর ও পরবর্তীতে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

এ লেখায় উল্লিখিত কিছু তথ্য নেওয়া হয়েছে ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র; তৃতীয়, নবম ও দশম খণ্ড ও নানান পত্রিকার ও ওয়েবসাইট থেকে ।

আব্দুল আজিজ
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Print Friendly, PDF & Email
 
 
স্বাধীন খবর ডটকম/আ আ
 

জনপ্রিয় সংবাদ

 

সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদ