বাজেট দিয়ে সরকারের চরিত্র বিচার
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
রবিবার, জুন ১২, ২০২২ ৯:১৯ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
রবিবার, জুন ১২, ২০২২ ৯:২০ অপরাহ্ণ
ডা. জাহেদ উর রহমান
ছোটবেলায় দেখতাম বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকতো বাজেটে কোন জিনিসের দাম বাড়ছে কিংবা কোন জিনিসের দাম কমছে সেটা। দেশে এখন অনেকগুলো প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া আছে। এসব মিডিয়ায় অর্থনীতিবিদরা এসে বাজেটের নানা দিক নিয়ে কথা বলছেন। ফলে শিক্ষিতদের মধ্যে বাজেট নিয়ে জানাশোনা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সচেতনতা।
আমাদের বাজেট আলোচনায় দীর্ঘমেয়াদি বিষয় নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলা হলেও মোটাদাগে আলোচনায় থাকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং সেটার মোকাবিলায় কী করা হচ্ছে সেসব বিষয়। বাজেট পর্যালোচনা করে একটা সরকারের দর্শন এবং মানসিকতার যে পরিচয় পাওয়া যায়, সেই আলাপ হয় কমই।
দেশের বাজেট বাস্তবায়নে অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অব্যবস্থাপনা আছে। আছে সীমাহীন লুটপাট। আজকের লেখায় সেই আলোচনায় আমি ঢুকবো না। শুধু বাজেটের আয় এবং ব্যয় করার ক্ষেত্রে সরকারের মানসিকতা দিয়ে সরকারের দর্শন বুঝতে চাইবো।
বাজেট আলোচনায় দীর্ঘমেয়াদি বিষয় নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলা হলেও মোটাদাগে আলোচনায় থাকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং সেটার মোকাবিলায় কী করা হচ্ছে সেসব বিষয়। বাজেট পর্যালোচনা করে একটা সরকারের দর্শন এবং মানসিকতার যে পরিচয় পাওয়া যায়, সেই আলাপ হয় কমই। দেশের বাজেট বাস্তবায়নে অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অব্যবস্থাপনা আছে।
আছে সীমাহীন লুটপাট।
অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ এবং ধরন দিয়ে মানুষ এবং সরকার চেনা সমান সদস্য আর একই পরিমাণ সীমিত আয়ের দুইটি পরিবারের কর্তারা সন্তানদের জন্য পুষ্টিকর খাবার, সুস্বাস্থ্য এবং সর্বোচ্চ মানের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ব্যয় করেন নাকি গৃহকর্তা তার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কিছু বিলাসী পণ্যের পেছনে ব্যয় করার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিকর খাবারের ব্যয় কমিয়ে আনেন, সেটা দিয়ে দুই কর্তার চরিত্রের বিশ্লেষণ করা যায়।
ঠিক এই ঘটনাটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও সত্য। একটি সরকার কোন কোন খাত থেকে আয় করতে চায়, আবার সেটা কোন কোন খাতে, কীভাবে সেটা ব্যয় করে সেটা সেই সরকারের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা দেয়।
বাজেটে পরোক্ষ কর সবচেয়ে ন্যায্য এবং নৈতিক কর ব্যবস্থা হতে পারতো এমন যে সরকার শুধু মানুষের আয় এবং সম্পদের উপর ভিত্তি করে কর নির্ধারণ হবে (প্রত্যক্ষ কর) এবং সেটি দিয়েই সরকার চলবে। পরোক্ষ কর (আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি) সমাজের ধনী-গরিব সবার ওপরে একই হারে প্রযোজ্য হয়। অর্থাৎ পরোক্ষ কর যত কম হয় সেটা তত মানবিক এবং ন্যায্য।
মজার ব্যাপার এবারকার বাজেটেও সরকারের আয়কর থেকে প্রাপ্য রাজস্ব ৩২.৭ শতাংশ। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই এখনো পরোক্ষ কর। আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়াতে আর সব দেশে মোট রাজস্ব আয়করের হিস্যা ৫০ শতাংশের মতো। আমরা জানলাম বাংলাদেশের সরকার ধনীদের ছাড় দিয়ে কম সামর্থ্যবান এবং গরিব মানুষের ঘাড়ে কর ধার্য করে বেশি।
আবার আয়করের ক্ষেত্রেও আছে সীমাহীন বৈষম্য। চাকরিজীবীদের আয় সহজে ট্রেইস করা যায় বলে তাদের উপরেই করের বোঝা চাপে অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যক্তিখাতে বছরের পর বছর সর্বোচ্চ কর দেন একজন জর্দা ব্যবসায়ী (হাকিমপুরী জর্দা) কাউছ মিয়া। এতেই বোঝা যায় অতি বড় ব্যবসায়ীরা কতবড় কর ফাঁকি দেন সরকারের নানা মহলের যোগসাজশে।
এবারের বাজেটেও ব্যক্তিখাতে করমুক্ত আয়ের সীমা রাখা হয়েছে বাৎসরিক মাত্র তিন লাখ টাকা। অর্থাৎ মাসে ২৫ হাজার টাকা। ভেবে দেখুন, কেমন সরকার হলে মনে করতে পারে মাসে মাত্র ২৫ হাজার টাকার বেশি আয় হলেই কোনো ব্যক্তিকে আয়কর দেয়া শুরু করতে হবে।
অতি সামান্য আয়ের ওপরে যখন আয়কর নির্ধারিত হয় এই দেশে তখন ব্যবসায়ীদের ব্যবসার কর্পোরেট ট্যাক্স কমে নিয়মিত। এ ছাড়াও বাংলাদেশে নেই কোনো সম্পদ কর। শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকার পর আয়করের ওপরে সামান্য কিছু সারচার্জ আরোপ করা হয়। অথচ সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ এবং ‘ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইডিওলজি’ বইয়ের লেখক থমাস পিকেটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, সম্পদ কর ছাড়া অর্থনৈতিক বৈষম্য উল্লেখযোগ্য ভাবে কমানো অসম্ভব।
সরকারের দুষ্টের পালন
বছরের পর বছর সরকার দেশে সামান্য কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার জন্য ব্যবস্থা রেখেছিল। একজন মানুষ সৎভাবে টাকাকে সাদা রাখতে যে কর দিতে হতো, অসৎ হয়ে টাকাকে কালো বানিয়ে পরে সাদা করতে তার চেয়ে অনেক কম খরচ করতে হতো। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে এটা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু যুক্ত হয়েছে আরও ভয়ঙ্কর বিষয়।
বিদেশে পাচার হওয়া টাকা বৈধ করা এবং দেশে ফেরত আনার নামে ৭ থেকে ১৫ শতাংশ কর ধার্য করে প্রশ্নাতীতভাবে সেগুলো প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে টাকা ফেরত আসার কোনো কারণ নেই, কিন্তু এটা আরও অনেককে টাকা পাচারে উৎসাহিত করবে। দুষ্টের দমন না করে দুষ্টকে এভাবেই পালন করে সরকার।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা
নাগরিকদের জীবনমানের ওপরে এসব ক্ষেত্রের বরাদ্দ খুব বড় প্রভাব ফেলে। স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশে জিডিপি’র অনুপাতে বরাদ্দ ক্রমাগত কমতে কমতে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে এটা ০.৮৩ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এটা হওয়া উচিত কমপক্ষে ৫ শতাংশ। জিডিপি’র অনুপাতে স্বাস্থ্য বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান, ভারত, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু রাষ্ট্রীয় ব্যয় যথাক্রমে ১২৯, ১৩৭, ১৬৭, ২৬৭, ২৮১, ৩৬৯, ১৯৯৬ ডলার। বাংলাদেশে এর পরিমাণ মাত্র ৮৮ ডলার, যা পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ এবং আফগানিস্তানের অর্ধেক। এর মাশুল আমরা দেই ব্যক্তিগত টাকা খরচ করে চিকিৎসা নেয়ার মাধ্যমে।
বর্তমানে মানুষকে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করার জন্য তার নিজের পকেট থেকে দিতে হয় ৭২ শতাংশ। এর ফল কতটা ভয়ঙ্কর সেটা প্রমাণ করবে এই তথ্যটি- প্রতি বছর এই দেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ৮৬ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে হয়।
শিক্ষার মানের আলোচনা সরিয়ে রেখেই বলি ইউনেস্কো কমপক্ষে ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছে শিক্ষায়, অথচ এবারের বাজেটে এটা দুই শতাংশের কম। আমাদের এই অঞ্চলের অনেক দেশ যখন শিক্ষার্থীদের নানারকম দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আলাদা বাজেট দেয় আমাদের সেসবের বালাই নেই। এর ফলস্বরূপ বেকারত্বের পরিস্থিতি কী হয়েছে, সেটা আমরা দেখছি।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিরাট এক বরাদ্দ দেখানোর চেষ্টা হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন এবং অবসরকালীন অন্য সুবিধা, সঞ্চয়পত্রের সুদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৃত্তি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সবগুলোকে এই শ্রেণির অধীনে যুক্ত করে একটা বড় অঙ্ক দেখানো হয়। এইসব ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কিছু মানুষ কম সামর্থ্যবান এমনকি দরিদ্রও আছেন। কিন্তু শুধুমাত্র দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে আছে ওএমএস, ভিজিএফ’র মতো কিছু খাদ্য সহায়তা প্রকল্প এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কয়েকটি ক্যাটাগরির নগদ ভাতা। এখানে জানিয়ে রাখি সরকারি গবেষণায় বলছে এসব ভাতার ৪৬ শতাংশ যায় সামর্থ্যবান মানুষের কাছে, যারা সরকারি দলের চেয়ারম্যান, মেম্বার কিংবা নেতাদের আত্মীয় কিংবা পরিচিত।
বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতার মত যেসব ভাতা দেয়া হয় তাতে মোট বরাদ্দ হয় মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকার মতো, যা এবারের বাজেটের হিসাবে জিডিপি’র মাত্র ০.১৭ শতাংশ। করোনায় দুই কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছিল নতুন করে। তার সঙ্গে সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির কারণে দরিদ্র হয়েছে আরও অসংখ্য মানুষ। অথচ দেখুন এই সুবিধাভোগীর সংখ্যা একটিও বাড়ানো হয়নি। বাড়ানো হয়নি ভাতার পরিমাণও। সঙ্গে আগে ওএমএসে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়া হতো সেটা বাড়িয়ে ১৫ টাকা কেজি করা হয়েছে।
এসব যখন ঘটছে তখন সরকার বাজেটে ৮৩ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। এরমধ্যে কৃষি ভর্তুকির কিছু টাকা সাধারণ মানুষের কাজে লাগবে। কিন্তু ভর্তুকির প্রধান অংশ যাবে বিদ্যুৎ খাতে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে কিংবা কম সক্ষমতায় চালিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের হাতে ভর্তুকির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা জনগণের অর্থ তুলে দেয়া হবে আগের বছরগুলোর মতো। দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষকে টাকা দিতে না চাওয়া সরকার কার হাতে অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা তুলে দেয়, দেখছি তো আমরা? সরকারের অদক্ষতা, দুর্নীতির কারণে অতি কম রাজস্ব আয় এই বছরের প্রস্তাবিত ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটের রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবেই ঘাটতি দেখা যাচ্ছে দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থবছর শেষে এটা আরও বাড়ে কারণ সরকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অযৌক্তিকভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নির্ধারণ করে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপির আকারের তুলনায় রাজস্ব আয়ের অনুপাত সবচেয়ে কম। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশ সর্বনিম্নে। বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণের পরিমাণ জিডিপি’র ৯ শতাংশের সামান্য বেশি। এ সময়ে ভারতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, নেপালে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৫ ও শ্রীলঙ্কায় ১৪ শতাংশ ছিল কর-জিডিপি’র গড় অনুপাত। আর উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশে এই অনুপাত ছিল গড়ে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অদক্ষতা এবং দুর্নীতির কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
জিডিপি’র আকার আর প্রবৃদ্ধিকে নিয়ে মিথ্যাচার
২০০৮ সালে সেই সময়ের বিশ্বমন্দার মধ্যেই ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি দু’জন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ এবং অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবীদ জাঁ পল ফিটুসীকে দায়িত্ব দেন জিডিপিভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিমাপের সমস্যা এবং এর বিকল্প নিয়ে প্রস্তাবনা দিতে। ২০১০ সালে বের হয় এই তিন লেখক-এর গবেষণার ফল- “মিসমেজারিং আওয়ার লাইভস: হোয়াই জিডিপি ডাজন’ট অ্যাড আপ” শিরোনামের বইতে। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি এবং সেটার ভিত্তিতে হিসাব করা মাথাপিছু আয় উন্নয়নের নির্দেশক হিসেবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে গত কয়েক দশক থেকেই, যা এই বইতে আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু আমাদের দেশে এই সেকেলে চর্চাটা তো চলছেই, সেটা আবার চলছে নানা রকম মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশের জিডিপি’র আকারকে অনেক বাড়িয়ে দেখানো হয় প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়কে বেশি দেখানোর জন্য। মজার ব্যাপার মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে দেখানোর জন্য শুধু জিডিপি’র আকার বাড়িয়ে দেখানো হয় তা না, কমিয়ে দেখানো হয় জনসংখ্যাও।
এ ছাড়াও জিডিপি’র আকার বাড়িয়ে দেখালে জিডিপি’র তুলনায় ঋণের পরিমাণ কম দেখা যায়। বর্তমানে যে সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে জিডিপি’র তুলনায় ঋণ ৪৫ শতাংশ পার হয়েছে। জিডিপি’র সঠিক হিসাব হলে দেখা যাবে এটা কমপক্ষে ৬০ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ আমরা এখনই বিপদসীমা পেরিয়ে গেছি।
বাজেটের দর্শন নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনার ট্রেন্ড
২০১৯ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দা আরডেন তার দেশে চালু করেছেন ‘ওয়েলবিইং বাজেট’। তার দেশের বাজেটের একেবারে কেন্দ্রে আছে তার রাষ্ট্রের প্রায় সব নাগরিকের জীবনের উঁচুমান এবং ভালো থাকা নিশ্চিত করা।
নিউজিল্যান্ড তার বাজেটে মাদকাসক্তি থেকে নাগরিকদের মুক্ত করা এবং দূরে রাখার জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ রাখে, শিশুদের দারিদ্র্য কমানোর জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখে। নিউজিল্যান্ড নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ চালু করেছে। এই মানসিক স্বাস্থ্য মানে মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা না, এটা মানে হচ্ছে মানুষকে মানসিকভাবে সুখী এবং সুন্দর রাখার চেষ্টা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যেটাকে বলে ‘পজেটিভ সাইকোলজি’, সেটা নিশ্চিত করা। ‘ওয়েলবিইং বাজেট’-এ ডমেস্টিক ভায়োলেন্স কমানোর জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ আছে।
এটা নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশই নয়, আমাদের পাশের ছোট্ট দেশ ভুটানও এই ক্ষেত্রে পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছে। তাদের গুরুত্ব গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্ট (জিডিপি)-এর প্রতি নয় বরং গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএইচ) এর প্রতি। সামগ্রিক জাতীয় সুখ বৃদ্ধি করার সকল শর্ত রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে, এমন ধারা যুক্ত করে ২০০৮ সালে সংবিধান সংশোধন করেছে তারা। নিয়মিতভাবে তারা জনগণের সুখ পরিমাপ করে। সেই দেশে আছে একটি সুখ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও। তাদের বাজেটেও মনোযোগ থাকে জনগণকে সুখী করে তোলার চেষ্টা।
বুঝতে পারছি নিশ্চয়ই বাজেট নিয়ে আমরা এখনো রীতিমতো ‘প্রাগৈতিহাসিক’ জায়গায় পড়ে আছি। এবং সেটাতেও সরকারের আয় করার ধরন এবং ব্যয়ের ক্ষেত্র এবং পরিমাণ দেখে সরকারের চরিত্র সম্পর্কে ধারণা পেতে আমাদের নিশ্চয়ই সমস্যা হচ্ছে না।