বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে প্রয়োজন জনগণের ক্ষমতায়ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২ ৭:০৪ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২ ৭:০৪ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ
কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের দেয়া স্যাংশনের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ সম্ভব নয়। এই ধরনের পদক্ষেপ সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সমাধানের জন্য নিজেদের উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরানোর পাশাপাশি জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার ভয় নিয়ে কোনো সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না।
বুধবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : বেহাল গণতন্ত্র, প্রশ্নবিদ্ধ আইনের শাসন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। ওয়েবিনার আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এমপি বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কারও কাম্য নয়। নানা কারণে ঘটনাগুলো ঘটে যায়।
২০১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছিল তখন পুলিশ র্যাব পুরস্কার পাওয়ার মতো ভূমিকা রেখেছে। অত্যন্ত দক্ষ অফিসার বেনজিরসহ বহু পুলিশকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। আবার অন্যায়ের জন্য অনেকের শাস্তি হয়েছে। যেমন কয়দিন আগে একজনকে ফাঁসিও দেয়া হলো। শাজাহান খান বলেন, সন্ত্রাসীদের দমন করার জন্য পুলিশ র্যাব অনেক সময় অনেক কিছুই করেছে। আমাদের দেখা বহু পরিবার সন্ত্রাসীদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। এসব ঘটনায় মামলা হয়নি।
শুধু এরশাদ শিকদারের বিচার আওয়ামী লীগ করেছে। কখনও কখনও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রাজনৈতিক। যেমন বিএনপির শাসনামলে রংপুরে শ্রমিক নেতা আবুল কালাম আজাদকে প্রথমে জেলে নেওয়া হয়েছিল এবং তিনদিন পর জেল থেকে বের করে হত্যা করা হয়েছে। জনগণের শান্তির জন্য বিভিন্ন সময় এসব কাজ করেছে সরকার। বাস্তবতার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের দেশের শান্তি শৃঙ্খলার জন্য অনেক কিছু করি। অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ে কখনও উন্নয়ন হয় না। দেশে শান্তি থাকতে হয়।
শুধু কথা বলে উন্নয়ন হয়না। কথা বলার অধিকারের পাশাপাশি উন্নয়নও প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, যখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সন্ত্রাসের অনুপ্রবেশ ঘটেছে কখনই সেখানে সন্ত্রাস জয়লাভ করেনি। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকাদের সবারই গণতান্ত্রিক চর্চার মনমাসিকতা থাকতে হবে। আমরা সবাই চাই কোনো ধরণের হত্যাকাণ্ড ছাড়াই রাষ্ট্র পরিচালিত হোক।
বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ- এর আহবায়ক ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ আদেশগুলি এক জায়গা থেকে আসে। হত্যাকাণ্ডের যে প্যাটার্ন তা সরকারের ক্ষমতায় থাকার একটা ইনস্ট্রুমেন্ট। স্যাংশনের পর সরকারের রিঅ্যাকশন খুবই হতাশাজনক। যাদের বিরুদ্ধে স্যাংশন দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো সরকার তদন্ত করেনি, ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো তাদের পুরস্কৃত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত তথ্যের ওপর স্যাংশন দিয়ে থাকে। এসব থেকে সন্দেহ হয় সরকার এমন হত্যাকাণ্ডের পেছনে।
বিএনপি’র সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে যা ঘটেছে তার দায়িত্ব দেশ পরিচালনায় থাকা রাজনীতিবিদদের নিতে হবে। যারা রাষ্ট্র ব্যবস্থা যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের এই দায় নিতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে এখন আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। রাজনীতির মধ্যেই এই সমস্যা নিহিত। রাজনীতির মাধ্যমেই এটা সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সম্পর্ক রয়েছে।
এর সমাধান হিসেবে গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। এর জন্যও জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন। আইনের শাসন না থাকলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। জাতীয় ঐকমত্য মৌলিক কিছু বিষয়ে হতে হবে। মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণের হাতে ক্ষমতা পরিবর্তনের শক্তি না আসবে ততক্ষণ উন্নয়নের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে থাকবে। ১৮ কোটি মানুষের কাছে যদি প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতার ভয় থাকলে এগুলো বন্ধ হয়ে যেত। জনগণের ভয়ে রাজনীতিবিদরা ভীত থাকলেই একমাত্র বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমাধান।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ)- এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, শুধুমাত্র বিভিন্ন ঘটনা উদঘাটন করার জন্য আমাদের আইন প্রণেতাদের সংসদে উচকিত হতে হবে, সাব কমিটি যেগুলো আছে সেগুলোকে উচ্চকিত হতে হবে। যারা তদন্তের দায়িত্বে আছেন তারা যেন আইন হাতে তুলে না নেন। হিউম্যান রাইটস এডুকেশনের ওপরও জোর দেয়া জরুরি। পাশাপাশি আমাদের দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন বলেন, গত ৩ বছরে ৫৯০ জনের মতো মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর দুইমাসে মাত্র একটি ঘটনা ঘটে। সেটা একটা বিরতি ছিল মাত্র। কারণ মেজর সিনহার পেশাগত সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া ছিল। ১০ ডিসেম্বর মার্কিন স্যাংশেনের পর অপরাধীদের পুলিশের ওপর গুলির ঘটনা কমে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও কমে গেছে। গত ১০ বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা পদক পেয়েছেন তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার বা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ রয়েছে।
অতীতে যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ছিল তাদের প্রমোশন বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পদক দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, উন্নয়নের জন্য রক্ত দিব এটা ভাবতে পারছি না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য এই ধরণের ঘটনা ঘটলে সংসদের দরকার নাই। এত বিচারালয়ের দরকার নাই।
রাষ্ট্রদূত মো. শফিউল্লাহ বলেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী রাষ্ট্রদূত বিদায়ের আগে বিদায়ী রাষ্ট্রদূত তিনজনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তা না করেই দেশ ত্যাগ করেছেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট পরবর্তী রাষ্ট্রদূতের কিছু প্রকাশ করেনি। আমাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে আছে সে বিষয়টি অনুধাবন করা দরকার।
সিজিএস চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতা উত্তর সময়েও বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তখনকার এই কাজে জড়িত যৌথবাহিনীকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় এসেও এসব ঘটনার বিচার করেননি। তিনি আরো উল্লেখ করেন, র্যাবের ওপর স্যাংশন এটা শুধু ব্যক্তির জন্য অপমানজনক হয়নি, পুরো জাতির জন্য অপমানজনক।
আমাদের মানবাধিকারকে কম্বোডিয়া, বেলারুশ কিংবা নর্থ কোরিয়ার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। এদিকে ১০ই ডিসেম্বরের পর থেকে সেই দুর্বল চিত্রনাট্য নাই হয়ে গেছে। এখন আর অপরাধীদের আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি চালানোর ঘটনা ঘটছে না। তার মানে কী স্যাংশনের পর অপরাধীরাই ভয় পেয়ে গেছে- প্রশ্ন রাখেন তিনি।