বিরাজমান অর্থনৈতিক সঙ্কট একমাত্র জ্বালানি সঙ্কটের ফল নয়, মূল কারণ রাজনৈতিক
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
সোমবার, অক্টোবর ২৪, ২০২২ ৩:১৭ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
সোমবার, অক্টোবর ২৪, ২০২২ ৩:১৭ অপরাহ্ণ
আলী রীয়াজ
বাংলাদেশে বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকট যা নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের টিকে থাকাই দুরূহ করে তুলেছে। তার কারণ কেবল মাত্র জ্বালানি সঙ্কট নয়। একে একমাত্র জ্বালানি সঙ্কটের ফল বলে হাজির করার মধ্যে একটা ভয়াবহ অসততা আছে। আছে অন্য সঙ্কটগুলো আড়াল করে এই অবস্থা অব্যাহত রাখার চেষ্টা।
এখনকার অবস্থার জন্য বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সঙ্কটকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করা হয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে জ্বালানি খাতে অনুসৃত নীতিমালা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কিন্তু কেবল জ্বালানি খাতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ এই সঙ্কটের অন্য কারণগুলোকে আড়াল করার সরকারি প্রচেষ্টার একটা অংশ। লক্ষ্য করলে দেখবেন আগে যখন অন্যরা জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতির কথা বলেছে সেই সময়ে সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলেছেন- এই খাতে সঙ্কট নেই। সকলের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হয়েছে, এমন কি বিদ্যুৎ রপ্তানির কথাও বলে হয়েছে। এখন সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন যে জ্বালানি সঙ্কট আছে, সাশ্রয়ী হন। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
বিজ্ঞাপন
প্রয়োজনে দিনেরবেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে’। তার এই কথা থেকে মনে হয় যেন ঘরে ঘরে চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ আছে, বিদ্যুৎ ব্যবহার করা না-করার সিদ্ধান্ত তাঁদের। যেখানে দিনে-রাতে অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎই থাকে না সেখানে গ্রাহকের ইচ্ছে-অনিচ্ছে কোনও বিষয় নয়, সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কি হবে। এলএনজি এখন আমরা আনছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ৬ মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কি না- জানি না’ (জাগোনিউজ, ২৩ অক্টোবর ২০২২)। অথচ এখনও প্রতিদিন সরকারের কেউ না কেউ এই বলে আশ্বস্ত করছেন রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই। আসল চিত্রটি কি সেটা নিয়ে একটা বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে।
অর্থনীতির এই অবস্থার পেছনে যে দেশ থেকে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতের লুটপাট, উন্নয়নের নামে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্পের ব্যয় অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি, লুটপাট কাজ করেছে সেগুলো এখন আড়াল করার জন্যেই ক্ষমতাসীনরা কেবল জ্বালানি খাতের দিকেই সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন। কেননা এতে করে বলা যাবে যে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলো। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গৃহীত উন্নয়ন কৌশলের কারণে। এটি এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে সরকারের একজন বলেন যে সংকট ভয়াবহ, আর আরেকজন বলেন ‘লোডশেডিং নিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না’ (বাংলা ট্রিবিউন, ২৩ অক্টোবর ২০২২)।
সঙ্কটের মাত্রা এবং প্রকৃতি বোঝার জন্যে দরকার পুরো অবস্থার দিকে তাকানো। খণ্ডিতভাবে একটি খাতের দিকে তাকিয়ে অবস্থা বোঝা যাবে না। এটা মনে রাখা জরুরি যে এই সঙ্কটের মূল কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক। এগুলো অকস্মাৎ আকাশ থেকে নেমে আসেনি। এগুলো তৈরি হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। বিরাজমান অবস্থার, দরিদ্র-মধ্যবিত্তের জীবনের ওপরে নেমে আসা এই খড়গের সমাধান একটি খাতের জন্যে বিশ্ব-বাজারকে দায়ী করা কিংবা জোড়াতালির ব্যবস্থা করা নয়। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তাতে শুধু এই ধরনের জোড়াতালির দিকেই মনোযোগ দেয়া হচ্ছে তা নয়, একই সঙ্গে আগে এই ধরনের নীতিমালায় যারা লাভবান হয়েছে তারাই আবারও সুবিধা ভোগ করছে। এইসব ব্যবস্থা সংকটের মাত্রা বাড়াবে। সরকার তা নিয়ে চিন্তিত কিনা তারচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে মানুষের এই দুর্ভোগের সমাধান কীভাবে হবে। একই ব্যবস্থা, একই নীতিমালা, একই গোষ্ঠীর স্বার্থের অনুকূলে পদক্ষেপ অবস্থার বদল ঘটাবে না।
[লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া।]