মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর সংবাদ সম্মেলন এর বক্তব্য
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শনিবার, মার্চ ১২, ২০২২ ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শনিবার, মার্চ ১২, ২০২২ ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আসসালামু আলাইকুম
২০১৩ সালে আইসিটি অ্যাক্ট সংশোধন করে ৫৭ ধারা যোগ করে এবং ২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের জনগণ এবং মিডিয়ার বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত করার পর এখন অবশিষ্ট সামান্য যে বাকস্বাধীনতা টুকু রয়েছে সেটুকু পুরোপুরি কেড়ে নেয়ার জন্য সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি নতুন নীতিমালা বা রেগুলেশন জারির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গত ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ তারিখে বিটিআরসির ওয়েবসাইটে দেওয়া ও ইংরেজিতে লেখা খসড়া নীতিমালাকে ‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস ২০২১’ হিসেবে উল্লেখ করে ৫ মার্চ ২০২২ তারিখের মধ্যে পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশ চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ তারিখে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১ (খসড়া)’ শিরোনামে আরেকটি খসড়া নীতিমালা দিয়ে সংশোধন/মতামত চাওয়া হয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখের মধ্যে।
নিবর্তনমূল এই দু’টি নীতিমালা কার্যকর করা হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি অনলাইন ভিত্তিক মিডিয়াগুলোর মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে, পাশাপাশি অনলাইন এনক্রিপশনকে অকার্যকর করে নিরাপত্তাকে দুর্বল করে ফেলবে। এর ফলে মানবাধিকারের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে এবং সাংবাদিক, বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী এবং ধর্মীয় ও সাংষ্কৃতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্টী আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
বিটিআরসির খসড়া নীতিমালার প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ‘মধ্যস্থতাকারী’ (ইন্টারমিডিয়ারি) হিসেবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সংজ্ঞায়িত করে দ্বিতীয় অধ্যায়ের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে তার দায়িত্ব বর্ণনা করে লেখা হয়েছে- তিনি/বা তারা এটা নিশ্চিত করবেন যেন সামাজিক মাধ্যমসহ অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে ১৫টি বিষয় নিয়ে লেখা, ছবি, ভিডিও বা তথ্য প্রচার করা না হয়। এর মধ্যে রয়েছে-
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ঐক্য, অখণ্ডতা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা অথবা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায় এমন বিষয়; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে যায় এমন বিষয়;
ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিকে আঘাত করে এমন বিষয়;
সরকারের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে এমন বিষয়;
বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায় এমন বিষয়;
কোনো ব্যক্তির প্রতি আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, হুমকি বা ভীতি-প্রদর্শক ও অপমানজনক বা মানহানিকর এমন বিষয়।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আওয়ামী লীগ সরকারের সমস্যা হচ্ছে- তারা রাষ্ট্র এবং সরকারকে এক করে দেখে। সেই কারণে সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলেও তারা সেটাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রচার বলে মনে করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা সহ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর আওতায় মামলা দিয়ে তাদেরকে হয়রানির মধ্যে ফেলে।
স্মরণ করা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখার কারণে ২০১৫ সালে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছিল। অতিসম্প্রতি আমরা দেখতে পেলাম সেই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এর ছোট ভাইকে ২০০০ কোটি টাকা পাচারের দায়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যে পরিমাণ ইতিহাস বিকৃতি করেছে সেই বিষয়ে কথা না বলার জন্যও তারা এই নীতিমালা ব্যবহার করবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়েছে, দেশের মানুষ সেই ঘোষণা শুনেছে, বিদেশী পত্র-পত্রিকায় সে ঘোষনার কথা প্রকাশ হয়েছে, তার পরেও উনারা কোর্টর আদেশ আর সংবিধান সংশোধন করে স্বাধীনতার ঘোষকের নাম বদলে দিয়েছেন। ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে উনারা আদালত আর সংবিধানের মাধ্যমে বদলে দেন আর তারপর সে বিকৃত ইতিহাস রক্ষার জন্য এখন এই ধরনের নিবর্তনমূলক নীতিমালার পেছনে আশ্রয় নিতে চাচ্ছেন।
দুর্নীতি, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা এবং দলীয়করণের কারণে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার বইতে দেখিয়েছেন। ১৯৭২-৭৫ সময়ে রক্ষীবাহিনী সহ তৎকালীন আওয়ামী লীগের লাল বাহিনী টাইপের বাহিনীর হাতে ৩০ হাজারের বেশি বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল। এই সকল কারণে সমালোচনা করলে সেটাও এই নীতিমালার আওতায় অপরাধ বলে গণ্য হবে।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করার কারণে গতবছর সাংবাদিক রোজিনাকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছিল। সেই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যে রোজিনা সরকারের গোপন নথি চুরি করেছিল। সরকার পরিচালনায় থাকা আমলা মন্ত্রীরা যদি দুর্নীতি করেন তাহলে সেগুলো মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমে যেন প্রচার করা না হয় সেটার রক্ষাকবচ হিসেবে ও বিটিআরসির এই নীতিমালা ব্যবহার করা যাবে।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব হয় রাষ্ট্রের। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, দুই একটি রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব হয় আওয়ামী লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের। এমন কোন রাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয় তখন স্বাভাবিকভাবেই দেশের জনগণ এবং মিডিয়ায় সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হতে পারে এবং এটিই স্বাভাবিক। বিটিআরসির প্রস্তাবিত নীতিমালার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের সেই প্রতিবাদের মুখে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
বিটিআরসির নীতিমালার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক অংশটি হচ্ছে- ‘কোনো ব্যক্তির প্রতি আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, হুমকি বা ভীতি-প্রদর্শক ও অপমানজনক বা মানহানিকর’ বিষয় প্রচার করা যাবে না। গত এক যুগের বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা, মানহানিকর এবং নোংরা অপপ্রচার করা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এসব মানহানিকর, মিথ্যা এবং নোংরা অপপ্রচারের অধিকাংশই হয়েছে সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং সরকারপন্থী মিডিয়ার মাধ্যমে। বারবার আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগ সরকার নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থায় কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে অতিসম্প্রতি স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার দৌহিত্র এবং বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমানের কন্যা ব্যারিস্টার জাইমা রহমান কে নিয়ে ডাক্তার মুরাদ যে জঘন্য নোংরা মিথ্যাচার করেছিল সেই বিষয়ে মামলা করতে গেলে আদালত মামলা গ্রহণ করেনি।
কিন্তু একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ওয়ার্ড পর্যায়ের কোনো নেতার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও যদি কোনো কিছু লেখা হয় বা প্রকাশ করা হয় তাহলেও বিটিআরসির এই নীতিমালার মাধ্যমে সেই লেখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
সোজা কথায় বলা যায় এই নিবর্তনমূলক নীতিমালাটির তৈরি করা হয়েছে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি-অপশাসন, তাদের ভোট ডাকাতি, তাদের মানবাধিকার লংঘন এবং গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলোর প্রচার ঠেকাতে।
এমনকি এই বিষয়গুলো যেন আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়াতে প্রচার হলে সেগুলো বাংলাদেশর জনগণ দেখতে না পায়, সেই জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১ (খসড়া)’ টি প্রনয়ণ করা হয়েছে।
ফেসবুক, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, হইচই এবং অ্যামাজন প্রাইম-সহ বিনোদনের ওটিটি প্লাটফর্মগুলোকে বাংলাদেশে তাদের সম্প্রচার চালাতে হলে সেই একই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
বিটিআরসি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এই দুটি নীতিমালা শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিকই নয় বরং জাতিসংঘ ঘোষিত ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস (ইউ ডি এইচ আর) এবং ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্যান্ট অন সিভিল এ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আই সি সি পি আর) এর পরিপন্থী। সেই সাথে জাতিসংঘের অনুমোদিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ম্যানিলা প্রিন্সিপাল এবং সান্তা ক্লারা প্রিন্সিপাল এর সিদ্ধান্তের দৃষ্টিতে দেখলে এই দুটি নীতিমালা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘণ।
গত ৭ মার্চ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান কে এই বিষয়ে জানানো হয়েছে।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে- কোন নিবর্তনমূলক আইন দিয়েই তথ্যের প্রচার বন্ধ করা যায় না। মানুষ সত্য জানার আগ্রহ থেকেই তারা সত্য তথ্যটির উৎস খুঁজে বের করে। সেই কারণেই সংবাদপত্রের বিকল্প হিসেবে এসেছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং তারপর এসেছে এই অনলাইন ভিত্তিক বিকল্প সামাজিক মাধ্যম এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম।
এই নীতিমালা প্রণয়নের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হচ্ছে সত্য কে আড়াল করে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠরূদ্ধ করে একদলীয় বাকশালী কায়দায় ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা।
মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এমনিতেই তলানীতে এমনকি মিয়ানমারের চেয়েও পেছনে। সরকারের এই দুই নীতিমালা তাদের দুর্নীতি অপশাসন আর গুম খুনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের প্রচার থামাতে না পারলেও মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও পিছিয়ে উত্তর কোরিয়ার কাতারের গিয়ে দাঁড়াবে। আমরা বাংলাদেশের এমন অসম্মান দেখতে চাই না। সেই কারণে দেশের জনগণের বাক স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম এবং দেশি-বিদেশি ওটিপি প্ল্যাটফর্মের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে বিটিআরসি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এই দুই নীতিমালাসহ ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করতে হবে। নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি।