শরিফ উদ্দিন ও দুর্নীতির ‘দোসর কমিশন’
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
মঙ্গলবার, মার্চ ১, ২০২২ ৫:৫২ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
মঙ্গলবার, মার্চ ১, ২০২২ ৫:৫২ অপরাহ্ণ
রুমিন ফারহানা
মাঠে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ, পাশে পড়ে আছে গুলির খোসা, গুলি আর অস্ত্র। ভিডিওতে এমন একটা দৃশ্য দেখানোর সময় শোনা যায় ক্রসফায়ার/ বন্দুকযুদ্ধে কাউকে হত্যার পর বলা সেই ক্লিশে গল্পটা। আর যেটা শোনা যায়, সেটা হচ্ছে হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষটির বিরুদ্ধে কোন কোন অভিযোগে কয়টা মামলা ছিল। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এই অতি পরিচিত ঘটনাগুলো মনে পড়লো দুদক কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির পর।
শরিফের বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগের এক লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছেন দুদক সচিব। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেই তাকে সোজা চাকরিচ্যুত করা আর কিছু কথিত অপরাধের কথা বলে কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করা কার্যত একই। দুদক সচিবের দেওয়া শরিফের কথিত অপরাধগুলোর তালিকা পড়েছি। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, সেই সঙ্গে তার জবাব পড়লে কারও বুঝতে বাকি থাকে না নানাদিকের চাপে পড়ে দুদক সচিব কতগুলো খোঁড়া যুক্তি হাজির করেছেন।
শরিফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে চাকরিবিধির ৫৪(২) ধারা মতে, যেখানে বলা আছে কর্তৃপক্ষ যে কাউকে কোনও কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরি থেকে অপসারণ করতে পারে। ন্যাচারাল জাস্টিসের মৌলিক ধারণা এবং বাংলাদেশ সংবিধানের ১৩৫(২) পরিপন্থী এমন একটি ধারা দুদক আইনে থাকাটা অবিশ্বাস্য। এমন ধারার অস্তিত্ব থাকাটা প্রমাণ করে, দুদক কর্মকর্তাদের জন্য সরকারের বেঁধে দেওয়া একটা চৌহদ্দি আছে, যার ভেতরে আছে বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিরোধী মতের মানুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের আইওয়াশ দেওয়ার জন্য সরকারদলীয় কিছু চুনোপুঁটি আর তদন্তের নামে প্রহসন করে ‘মাসুম’ সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য কিছু সরকারদলীয় রাঘব-বোয়াল। কেউ যদি সত্যিকারভাবে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংযুক্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অতি প্রভাবশালীদের ‘বাড়া ভাতে ছাই’ দিতে যায়, তাঁকে মুহূর্তেই যেন শায়েস্তা করে ফেলা যায়, সেই পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিল ২০০৮ সালে তৈরি দুদক বিধিমালাতেই।
চাকরিবিধির ৪০-৪৩ ধারায় কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে কী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে তার বিবরণ দেওয়া আছে। সেখানে কারণ দর্শানো থেকে শুরু করে শুনানি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু শরিফের মতো কর্মকর্তা যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে দুদককে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তার ক্ষেত্রে ৫৪(২)ধারা নিঃসন্দেহে দুদকের জন্য স্বস্তির।
৫৪(২) ধারার বৈধতা ইতোমধ্যে রিটের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এই ধারার ওপর কোনও স্থিতাদেশ না থাকলে এই ধারায় কাউকে চাকরিচ্যুত করার আইনি বাধা না থাকলেও নৈতিকতার বিচারে সেটি খুব শোভনীয় নয়। দুদকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি মানুষের অন্যায় খুঁজে বের করার জন্য গঠিত হয়েছে, তার দিক থেকে এমন পদক্ষেপ একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত।
দুদকে প্রশাসন, তথ্য ক্যাডার এবং জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরত কর্মকর্তাদেরও পদায়ন হয়। একই ধরনের ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে এভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, ঘটনার ঠিক পর পর প্রথম আলো থেকে করা এমন একটি প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব জানান, হবে না, তাঁদের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারী আইন প্রযোজ্য হবে। এই আইনে আছে প্রচণ্ড আপত্তিকর বিষয়।
সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪১(১) ধারা বলছে – ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সহিত সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হইবার পূর্বে, তাহাকে গ্রেফতার করিতে হইলে, সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করিতে হইবে’।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারাতেও সরকারি কর্মচারীদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া আছে। এটা অনুসারে সরকারি কোনও কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেলে অভিযোগপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দফতরের অনুমোদন লাগবে। ওদিকে দুদকের ৩২(ক) ধারায় বলা হয়েছে, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৯৭-এর বিধান আবশ্যিকভাবে প্রতিপালন করিতে হইবে। ২০১৪ সালে এক রিটে হাইকোর্ট দুদক আইনের এই ধারা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সেটিকে অবৈধ ঘোষণা করে। কিন্তু ধারাটি এখনও আইনে বহাল আছে।
এটি স্পষ্ট যে সরকারি ক্যাডারভুক্ত আমলাদের জন্য সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারা যুক্ত করে আইন প্রণয়ন করা হয় অথচ দুদকের ক্ষেত্রে সংবিধানকে তোয়াক্কা না করে বিধিমালা তৈরি করা হয় এবং সেটা প্রয়োগ করা হয় নির্লজ্জের মতো। নিজেদের ক্ষমতার চৌহদ্দি পেরিয়ে এই দেশের আমলারা সর্বময় ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার আরেক নজির এটি।
দুর্নীতির সঙ্গে ক্ষমতা জড়িত। তাই দুর্নীতি মূলত করেন সরকারের রাজনৈতিক অংশ, সরকারের আমলা/কর্মচারী, সরকার দলীয় প্রভাবশালীরা। তাই দুদক যেসব কাজ করবে তার সঙ্গে স্বার্থের সরাসরি সংঘাত আছে সরকারের আমলাদের। তাই এই প্রতিষ্ঠানে প্রশাসন বা অন্যান্য ক্যাডারের আমলাদের পদায়ন কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। সঠিক ফল পেতে হলে দুদক পরিচালনা করা উচিত শুধু দুদকের জন্য নিয়োগকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা।
শরিফ উদ্দিন চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় কক্সবাজারে ৭২টি প্রকল্পে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের ২০টি এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি মামলা করেন। তার কর্মদক্ষতাকে প্রমাণের জন্য এটুকু তথ্যই যথেষ্ট যে চট্টগ্রামে সাড়ে তিন বছর দায়িত্ব পালনের সময় দুর্নীতির মোট ৩০টি মামলা করেন শরিফ উদ্দিন। এরমধ্যে অভিযোগপত্র দেন ১৫টির। অনুসন্ধান শেষে মামলার সুপারিশ করেন আরও ২২টির। বদলির আগ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দুর্নীতির মোট ৪৫টি মামলার তদন্ত করছিলেন।
শরিফ কতটা সাহসী কর্মকর্তা ছিলেন তার একটা ছোট্ট নজির হলো, গত বছরের জুনে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ প্রদান করায় সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর বড় ছেলে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।
রাঘব-বোয়ালদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে প্রাণনাশের হুমকিও পাচ্ছিলেন শরিফ, ছিল চাকরিচ্যুতির হুমকিও। তাই তার ওপর আঘাত এলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। র্যাব আর এর সদস্যদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যে আইনে দেওয়া হয়েছে সেটার প্রেক্ষাপটই ছিল রাশিয়ার দুর্নীতির তদন্তকারী আইনজীবী সার্গেই ম্যাগনিটস্কিকে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা। ম্যাগনিটস্কির তদন্ত করা ২৩ কোটি ডলার বা ২০০০ কোটি টাকা দুর্নীতিকে বর্তমান বাংলাদেশে একেবারে তুচ্ছ মনে হয়। এখন বাংলাদেশে দুর্নীতির পথে বাধা তৈরি হওয়া আর না হওয়ার মধ্যকার পার্থক্যটা এত অকল্পনীয় পরিমাণ বড় যে সেটার জন্য কিছু মানুষকে হত্যা করে পথের বাধা দূর করার সঙ্গে যদি বাকিদের সতর্ক করা যায়, তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে?
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।