শান্তি ও অরক্ষিত সীমান্ত!
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
রবিবার, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২ ৬:০৫ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
রবিবার, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২২ ৭:২৭ অপরাহ্ণ
পাকিস্তান আমলে একটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল – Defence of East Pakistan lies in the defence of West Pakistan – অর্থাৎ — পশ্চিম পাকিস্তান টিকে থাকলে পূর্ব পাকিস্তান এমনিতেই টিকে যাবে!তার জন্য একটা দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে লাভ নেই। তাদের এই ভ্রান্তনীতি প্রথমে অসার প্রতিপন্ন হয় ১৯৬৫ সালে পাক- ভারত যুদ্ধের সময়।ভারতের করুনার কারনে সেবার পূর্বপাকিস্তান রক্ষা পেয়েছিল।
একাত্তর সালে যখন পূর্বপাকিস্তানে সশস্ত্র সংগ্রামের সম্ভাবনা দেখা দিয়ে ছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানে বিমান বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির কথা উঠলে সেটা নাকচ করে দেয় আর্মি হেড কোয়ার্টার। তখন প্রশ্ন আসে ভারত যদি হস্তক্ষেপ করে তাহলে কি ভাবে সাহায্য পৌঁছানো যাবে? তখন শীর্ষ স্হানীয় একজন জেনারেল নাকি রাগত স্বরে জবাব দিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বোমা ফেলেতে ফেলতে ভারতের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ঢাকা পৌঁছে আবার বোমা ফেলতে ফেলতে পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে আসবে তাদের বিমান বাহিনী।এতে নাকি সেদিন প্রচণ্ড হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিধানের এই হাস্যকর কৌশলের পরিনাম কত ভয়াবহ হয়েছিল সেটা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনুশোচনা করতে থাকবে। তবে তাদের এই ভুল রণকৌশল অবশ্য বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বস্তি দায়ক হয়েছিল ১৯৭১ এর মুক্তি যুদ্ধের সময়।
ওসব এখন অতীতের কথা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম নুতন তত্ত্ব। আমাদের তো আর কোন শত্রু নাই। আমাদের চার দিকে বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ছাড়া তো আর কে আছে? সুতরাং সেনাবাহিনী নামক শ্বেতহস্তী পোষণ করে কি লাভ?ভারতই তো আমাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি!ইতিহাসের পালা বদলের সাথে সাথে আমাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টিও বদলে গেল।পিন্ডি থেকে দিল্লি!
কথা গুলো মনে পড়ে গেল সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমারের ঔদ্ধত্য দেখে। প্রতিদিন একটা গোলা এসে পড়ে আর আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তর রাষ্ট্রদূত কে তলব করে প্রতিবাদ করে আর জাতিসংঘে যাবার হুমকি দেয়। কিন্তু এতে কি কাজ হচ্ছে? কেন হচ্ছে না? কারণ মায়ানমার হয়তো জানে আমাদের কুয়ত কতটুকু। আপনার দুর্বলতা সম্পর্কে প্রতিপক্ষ যখন অবহিত থাকবে তখন তার আচরণ একরকম হবে আবার যখন শক্তি সম্পর্কে অবহিত থাকবে তখন তার আচরণ অন্য রকম হবে । এজন্য সবসময় প্রতিবেশীর সাথে বা প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। এটা সামরিক কৌশলগত ব্যাপার। ১৯৭৪ সালে ভারত পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে ভুট্টো ঘোষণা দেন প্রয়োজনে ঘাস খেয়ে হলেও পারমাণবিক বোমা বানাবেন। আমেরিকা সহ পশ্চিমারা প্রবল ভাবে পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার বিরোধিতা করলেও পাকিস্তানকে নিবৃত করা যায় নি।তাদের পরমাণু বিজ্ঞানী কাদের খানের নেতৃত্বে তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি শুধু নয় নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্হা ও তৈরি করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধ বিমান রনতরী সবই তৈরি করছে তারা।ইরানের কথাই চিন্তা করিনা কেন? তাদের সামরিক শক্তি এতটা এগিয়ে গেছে যে খোদ আমেরিকা এবং ইসরায়েলের মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে। কোন দেশের সাহায্য ছাড়াই ইরান নিজস্ব রণতরী, সাবমেরিন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্হা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। কথায় বলে না – Necessity is the mother of invention? ইরান এখন যে কোন সময় ইচ্ছে করলে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম। ক্ষুদ্র একটি দেশ উত্তর কোরিয়ার সামরিক শক্তি আমেরিকার মতো পরাশক্তির ও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন । বিশাল সামরিক শক্তির দেশ ভারত এখন পাকিস্তান কে সমীহ করে চলতে হয় । যত হম্বিতম্বি করুক না কেন মোদির গেরুয়া বাহিনী বসে বসে আঙুল চোষা ছাড়া আর কি করতে পারছে? অথচ তাদের বিএসএফ সীমান্তে প্রতিদিন আমাদের নিরীহ মানুষ হত্যা করে কিন্তু পাকিস্তানের দিকে একটা গুলি ও কি ছোঁড়ে? মায়ানমারের সেনবাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দশলাখের বেশি মানুষ আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে বসেছে । আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রিলিফ দিয়ে দায় শেষ। প্রশ্ন কত বছর এই বোঝা বইতে হবে আমাদের? এটা কি তবে দ্বিতীয় ফিলিস্তিন হয়ে গেল? মায়ানমার একদিকে চীন অপর দিকে ভারত দুই পরাশক্তি কে কৌশলে নিজের কাজে লাগাচ্ছে। আমাদের কি উচিৎ ছিল ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া আর তুরস্কের দিকে সামরিক সহযোগিতার জন্য হাত বাড়ানোর? না তা কেন হবে? বন্ধু রাষ্ট্র ভারত যদি আবার গোস্বা করে!
এখন আবার নুতন মুসিবত হাজির। প্রতিদিন মায়ানমারের গোলা এসে পড়েছে আমাদের পূর্ব সীমান্তে।একটা গোলা এসে পড়ে আর রাষ্ট্রদূত কে তলব করে কড়া প্রতিবাদ হয়।আবার গোলা এসে পড়ে আবার প্রতিবাদ। জাতিসংঘে নালিশ করার ধমক। কিন্তু কাজ হচ্ছে কই? কারন তারা জানে আমাদের শক্তি কতটুকু।
এজন্যই যুদ্ধ বা শান্তি যে কোন অবস্থায় রণ প্রস্তুতি থাকতেই হয়। এই প্রস্তুতিই deterrent বা নিবৃতি কারক হিসেবে কাজ করে। অরক্ষিত সীমান্ত সবসময় আগ্রাসী শক্তি কে উৎসাহ যোগায়।ক্ষেতের বেড়া না থাকলে গরু ছাগলের মুখ বন্ধ করা যায় কি?
এখন আড়ালে আবডালে যা শুনাযায় তার সারমর্ম হচ্ছে মায়ানমার সামরিক শক্তিতে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বলীয়ান। সুতরাং এমূহুর্তে তাদের সাথে কোন ধরনের কনফ্রন্টেশনে যাওয়া ঠিক হবে না। সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুজতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো একসময় সামরিক দিক থেকে দুর্বল মায়ানমার কখন আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেল? আমরা কেন পিছিয়ে গেলাম?এক সময় ইপিআর এর ধাওয়া খেয়ে যারা বাপ বাপ করে পালাতো তারা এত শক্তি সঞ্চয় করলো কখন?
শান্তি সব মানমানুষের কাম্য।তবে শান্তি যখন অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন শান্তির জন্য নোবেল পুরষ্কার এর আশায় বেহুদা সময় নষ্ট করে কি লাভ? মিশরের আনোয়ার সাদত শান্তির জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।তার খেসারত কি এখন পুরো মধ্য প্রাচ্য কে বিশেষ করে ফিলিস্তিনের মানুষ কে দিতে হচ্ছে না? আসলে পৃথিবীতে শান্তির গ্যারান্টি দিতে পারে একমাত্র নিজের বাহু বল তথা সামরিক শক্তি ও প্রস্তুতি। সীমান্ত অরক্ষিত রেখে কখনো শান্তির গ্যারান্টি পাওয়া যায় না।
কিন্তু এসব ভাবার অবকাশ কোথায়? আমাদের সেনাবাহিনীর এখন একমাত্র লক্ষ্য হলো জাতি সংঘ শান্তি রক্ষা মিশন এবং ঠিকাদারি ও কর্পোরেট বানিজ্য। এই দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টানো এখন সময়ের দাবি।
জেনারেল ম্যাকআর্থারের একটা বিখ্যাত উক্তি মনে পরে গেল — In a war there is no alternative for a victory.
ওম শান্তি! ওম শান্তি!
(কাজী ফেরদৌস সাহেবের দেয়াল থেকে)