সিঁদুরে মেঘ দেখছি ঘরপোড়া গরুরা
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
শনিবার, মার্চ ৫, ২০২২ ৬:০১ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
শনিবার, মার্চ ৫, ২০২২ ৬:০১ অপরাহ্ণ
মারুফ কামাল খান
শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে মার্কিনপন্থী ছিলেন। তরুণ বয়সে ১৯৫২ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রাম (আইভিএলপি)-এ প্রশিক্ষণও নিয়ে এসেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ সিম্পসন ফারল্যান্ড-এর সঙ্গে একান্ত বৈঠকের পরই তিনি তাঁর পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছিলেন। ২৫ মার্চ তিনি পাকিস্তানি সেনাদের কাছে আত্মসমর্ণের পর কারাগারে তাঁর নিরাপত্তার পূর্ণ নিশ্চয়তা যুক্তরাষ্ট্রই দিয়েছিল বলে একটি দৃঢ় অভিমত তখন থেকেই চাউর আছে।
গোয়েন্দাবৃত্তি ও কূটনীতি উভয় ক্ষেত্রে ফারল্যান্ড সায়েবের ব্যাপক পারদর্শিতা ও দক্ষতা ছিল। তার আয়োজনেই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আলোচিত কূটনীতিবিদ, ইহুদি শরণার্থী, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হয়ে গোপনে চীন সফর করেন। চৌ এন লাই-এর সঙ্গে বৈঠক হয় তার। এরই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন সফরে যান।
সে-কালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের মিতালি স্থাপনে প্রথম দুতিয়ালি শুরু করেছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পরে সামরিক শাসনকর্তা আইউবের আমলে পাকিস্তানের সেই মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা বহাল ছিল। সেটা নিক্সনের সফরের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য শেখ মুজিবও মার্কিন-চীন মৈত্রীর বড় সমর্থকই ছিলেন।
শেখ সাহেবের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিন্যাস ও সমীকরণকে সম্পূর্ণ পৃথক কক্ষপথে চালিত করে। মুক্তিযুদ্ধের মিত্রশক্তি ইন্ডিয়া সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূল মনোভাব না পেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। আমেরিকা-চীন আবির্ভূত হয় পাকিস্তানের বন্ধু হিসেবে। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে শেখ সাহেব অনুভব করেন এই বিন্যাস রদ করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই তিনি ভোল পাল্টে রাতারাতি সমাজতন্ত্রী সাজেন এবং রুশ-ভারত অক্ষশক্তির বলয়ভুক্ত হয়ে যান।
যুক্তরাষ্ট্র শেখ সাহেবের ওপর অনেক বেশি ভরসা করতো। তাদের বিশ্বাস ছিল তাঁর মাধ্যমে সোভিয়েত বলয় থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে বাংলাদেশকে। শেখ সাহেবের যুক্তরাষ্ট্র সফর ও কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফরকালে তারা তাদের এ লক্ষ্য পূরণে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও পরে মন্ত্রীত্ব থেকে অপসারণের মাধ্যমে শেখ সাহেব কিছুটা উদ্যোগীও হন। গোপনে দূত পাঠিয়ে চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। ভারতের অমতে ওআইসি সন্মেলনেও যোগ দেন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অভিমুখ পালটানো দুঃসাধ্য ছিল। তাই তিনি নিজেও কেবলা বদল করে সমাজতান্ত্রিক শিবিরেই ভিড়ে যান।
কিউবার ওপর তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা স্যাংকশন চলছিল। কিউবান বিপ্লবের পর সেদেশে আমেরিকার মালিকানাধীন তেল কোম্পানি জাতীয়করণ করার পালটা প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় খাদ্য ও ওষুধ ছাড়া সকল পণ্য রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ অবস্থায় শেখ সাহেব বাংলাদেশ থেকে কিউবায় চটের বস্তা রফতানি করেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়। এর আগে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে করা শেখ সাহেবের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট বাংলাদেশে খাদ্যশষ্য সরবরাহে রাজি হয়েছিল। কিন্তু কিউবায় পাটজাত পণ্য রফতানিতে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা বাংলাদেশ অভিমুখী মার্কিন খাদ্যশষ্যবাহী জাহাজ মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নেয়।
সে সময় ‘ফুড ফর পিস’ নামে আমেরিকার একটা কর্মসূচি ছিল। এর আওতায় গরীব ও খাদ্যঘাটতির দেশগুলোতে ইউএসএইড-এর মাধ্যমে দেয়া হতো খয়রাতি খাদ্য সহায়তা। পাব্লিক ল ৪৮০ অনুযায়ী এই কর্মসূচি পরিচালিত হতো বলে একে পিএল-৪৮০ও বলা হতো। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশে পিএল-৪৮০ সহায়তাও স্থগিত করে দেয়।
সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তখন আওয়ামী লুটপাটতন্ত্র কায়েম হয়েছিল। সংকট দেখে খাদ্যশষ্যের মজুতদারী ও মুনাফাখোরি চলছিল। খোলা সীমান্ত দিয়ে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে ভারতে অবাধে পাচার হয়ে যাচ্ছিল ধান-চাল-গম। বন্যা ও খরায় খাদ্যশষ্যের উৎপাদন মার খাওয়ায় সংকট আরো গভীর হয়। তখন আমেরিকার খাদ্য না আসায় ‘চুয়াত্তরের মহাদুর্ভিক্ষ নামে দেশে। লঙ্গরখানার জন্য বরাদ্দ খাবারও আওয়ামী চাটার দল চেটে খেয়ে ফেলে। ডাস্টবিনে ফেলা উচ্ছিষ্টের জন্য মানুষে-কুকুরে কাড়াকাড়ি হয়। লাখ লাখ মানুষ অনাহারে, অপুষ্টিতে মারা যায়।
বাংলাদেশের সে অবস্থা এখন ইতিহাসের দৃশ্যপট। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সার্বিক সম্পর্ক অনেক উন্নত এখন। আমাদের খাদ্যের ঘাটতি ও আকালও আগের পর্যায়ে নেই। এই করোনার সময়ে অনেকে টাকা নিয়ে টিকা দেয়নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র একাই আমাদেরকে সম্পূর্ণ বিনে পয়সায় সাড়ে ছয় কোটি ডোজ টিকা দিয়েছে। সেই খয়রাতি টিকা দিয়েই আমরা এ পর্যন্ত করোনা মোকাবিলা করে এসেছি। আমরা যে রোহিঙ্গা শরণার্থী পালতে পারছি, তার পেছনে প্রধান সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের। সাগরে ও স্থলে আমাদের প্রতিরক্ষাশক্তি জোরালো করতে কোটি কোটি ডলারের সহায়তা ও বিনে পয়সার সরঞ্জাম ওরাই দিচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, মানুষ পাচার রোধ ও পরিবেশ রক্ষায় তাদের সহায়তা ও প্রশিক্ষণের ওপর আমরা বহুলাংশেই নির্ভরশীল। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রর চেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা আর কোনো বাইরের দেশই নেয় নি।
দুনিয়ার কোনো দেশ, বিশেষ করে কোনো পরাশক্তিই নিখুঁত বা পারফেক্ট নয়। তবে আমাদের মতন দুর্বল ও গরীব দেশকে সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হয় জাতীয় স্বার্থের আলোকে মন্দের ভালো কে। আমরা ঘরপোড়া গরু। আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছি। ক্ষমতাসীন সরকারের ভুল বা হঠকারিতায় জাতি হিসেবে আমাদেরকে যেনো আবারো বড় কোনো মাশুল দিতে না হয়। জাতীয় বিপর্যয় এড়াতে আমাদের চাই খুব বাস্তবসম্মত, জাতীয় স্বার্থানুকূল, যৌক্তিক কূটনীতি।
মারুফ কামাল খান এর ফেইসবুক থেকে