৯০-এর পর থেকেই শুরু হয়েছে ছাত্ররাজনীতির পচন
নিজস্ব প্রতিবেদক, স্বাধীন খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
বৃহস্পতিবার, আগস্ট ৪, ২০২২ ৬:০৮ অপরাহ্ণ পরিবর্তনের তারিখ:
বৃহস্পতিবার, আগস্ট ৪, ২০২২ ৬:০৮ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ
ছাত্ররাই দেশের সকল অন্যায় ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশাল অবদান রেখেছে, সেই সংগঠনকে আজকে কী পরিমাণ দূষিত করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভু্যত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ‘৯০-এর পর থেকেই শুরু হয়েছে ছাত্ররাজনীতির পচন। ছাত্রদের রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়ে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররাজনীতির গৌরবের ধারাটিকে গলাটিপে হত্যা করছে। হত্যা করছে দেশাত্মবোধ, মানবিক মূল্যবোধকে।
ছাত্র রাজনীতির ‘একাল ও সেকাল’ নিয়ে একান্ত আলাপ করেছেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু।
দেশের মেধাবী তালিকায় অন্যতম অবস্থানে থেকে কী স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিলেন?
শামসুজ্জামান দুদু: ছাত্র রাজনীতিতে যখন কেউ আসে তখন তার মস্তিকে দুইটা কাজ করে। প্রথম কাজটি হচ্ছে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। এ জন্য গণতন্ত্রকামী মানুষ স্বপ্ন পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখা যায়। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সদ্য যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ প্রথমে হোঁচট খায়, স্বপ্ন ভেঙে যায়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা আসতে থাকে। সেই স্বপ্নগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। দেশের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়েই রাজনীতি শুরু করি। দেশে স্বপ্নের ছাত্র রাজনীতি প্রথম হোঁচট খায় স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে। তখন রাজনৈতিক দলকে বাতিল করা হয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বাতিল তালিকায় পড়ে যায়। পরবর্তীতে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছায়ায় ছাত্র রাজনীতির স্বাধীনতার সুবাতাস অনুভব করি। কিন্তু তিনি দুর্ভাগ্যক্রমে বেশি সময় পাননি। উনার শাহাদাতের পর ক্ষমতায় আসেন সামরিক স্বৈরশাসক হুসাইন মোহাম্মাদ এরশাদ।
স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ে আপনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সে সময়কার উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা যদি বলতেন?
শামসুজ্জামান দুদু: এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করেন। বিএনপি সরকারকে বাতিল করেন। সামরিক সরকার সামরিক আইন জারি করেন। এরপর ক্ষমতার সমন্বয় করা জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের কাছে টেনে নেয়। এর মধ্যে যারা বিভ্রান্ত ও ক্ষমতা লোভী ছিলেন তারাই এরশাদের সঙ্গে যোগ দেন। সেসময় ছাত্রদলের কয়েক নেতা যোগ দেন এরশাদের সঙ্গে। দেশে প্রথম এরশাদ বিরোধী মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হল থেকে বের হয়। ছাত্রদলই প্রথম এরশাদ বিরোধী মিছিলের নেতৃত্ব দেয়।
সেই সময়কার ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা কেমন ছিল?
শামসুজ্জামান দুদু: তৎকালীন ছাত্র সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নামে ‘ফ্রন্ট’ গঠন করে। তখন ছাত্র সংগঠন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করতে চাইলে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তখন ছাত্রদলসহ ৭টি ছাত্র সংগঠন একত্রিত হয়ে ‘সংগ্রামী ছাত্রজোট’ গঠন করে। যেটি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করে। তবে তারকা ঘোষিত নেতাদের বেশিরভাগ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ছিলেন। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট বাসদ এ সংগঠন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ছিল। তারা মুখে এরশাদ বিরোধী কথা বললেও কার্যকরী ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। যে কারণে ছাত্রদলের নেতৃত্বে যে সংগ্রামী ছাত্র জোট গঠন হয়। তারা বড় ভূমিকা পালন করে।
বর্তমান ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্বের পরিবেশ কতটুকু আছে বলে আপনি মনে করেন?
শামসুজ্জামান দুদু: পাকিস্তান আমল থেকে জনতার যে দাবি ছিল বাংলা ভাষার-মাতৃভাষার। সেই দাবিতেও কিন্তু সোচ্চার ছিল ছাত্ররা। এদেশের বুদ্ধিজীবীরা বাংলা ভাষার পক্ষে বললেও রাস্তায় নেমে প্রথম দাবি জানিয়েছিল ছাত্ররা। ছাত্ররা সংগঠিত হয়েছিল। ’৫২ ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররাই প্রথম তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিল। এই ধারাবাহিকতায় ’৬২ ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। এমন কি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ওই সময় যারা ’৭০ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ছিলেন। তারা ক্ষমতা যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন। সেই সময়কার ছাত্র নেতারা আপসহীনতার মাঝ থেকে বের এসে একাত্তরের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমি একথা এজন্যই বলছি, পাকিস্তান আমল থেকেই ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই ধারাবাহিকত দেশের প্রথম বাকশাল বিরোধী আন্দোলনও কিন্তু ছাত্ররাই করে ছিল। সেই আন্দোলনে তথাকথিত ৪০ হাজারের মতো বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। যার বড় অংশই ছিল ছাত্ররা। এই ধারাবাহিকতা দেখা যায়, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক, এমনকি বর্তমান সরকার বিরোধী আন্দোলন করেছে কিন্তু ছাত্ররাই। বর্তমান সময়ে গুম হওয়াদের মধ্যে ছাত্রদের সংখ্যায় বেশি। অতীতের উদয়মান ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে এখনকার ছাত্র রাজনীতির সাথে সামঞ্জস্য তেমনটা নেই। বর্তমানে ছাত্র সংগঠনগুলো যৌক্তিক পর্যায় পৌঁছাতে পারেনি।
ক্যাম্পাস রাজনীতিতে ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা কেমন?
শামসুজ্জামান দুদু: ছাত্র রাজনীতির হচ্ছে দুটি দিক। একটি হচ্ছে পাঠ্যপুস্তকে আরেকটি হচ্ছে দেশের মানুষের স্বার্থে। এক্ষেত্রে একজন ছাত্র তার অধিকার ও অভাবকে ধারণ করবে। পাঠ্যপুস্তকের সাথে দেশের স্বার্থকে মেলানো এটাই হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি। বর্তমান নির্যাতনের কষাঘাতে শিকার হওয়া মানুষের পক্ষে ছাত্ররা রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেনি। কারণ হিসেবে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন দায়ী। তারা অনিয়ম করে ঢাবিসহ সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর হল দখল করে আছেন। এক্ষেত্রে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোকে ক্যাম্পাসে থাকতে দেওয়া হয় না। এটি একটি ক্ষেত্রে ভয়াবহ দিক। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের উচিত ছাত্রদের অবস্থান নিশ্চিত করা। তাদের ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়া। প্রশাসনের উচিত অন্যায় থেকে ছাত্রদের রক্ষা করা। এ অন্যায় যদি অব্যাহত থাকে তবে দেশকে বিদ্রোহের মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে। এটা কারো জন্য ভালো হবে না।
ছাত্র সংগঠনগুলে ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মহড়া ও একে অপরকে প্রতিপক্ষ মনে করছে কেন?
শামসুজ্জামান দুদু: বর্তমান ক্যাম্পাসে কর্তৃত্ব বলতে যেটা বুঝায় তা সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনই করছে। অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো কীভাবে অস্ত্রের মহড়া দিবে? বর্তমানে এটা কখনো সম্ভব বলে মনে হয় না। কর্তৃত্ববাদীরা এককভাবে ক্যাম্পাস গুলোকে দখল করে রাখছে। এ ক্ষেত্রে পাল্টাপাল্টি মহড়ার কোন সুযোগ লক্ষ্য করা যায় না। অতীতে এমন দেখা গেলেও বর্তমান সরকারের ১৩ বছরের কেউ তা করতে পারেনি। এটা সহজ ও স্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতি না।
ছাত্র সংগঠন কীভাবে পরস্পরের দ্বন্দ্ব দূর করতে পারে?
শামসুজ্জামান দুদু: ছাত্র সংগঠন গুলোর দ্বন্দ্বটা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সাথে গণতন্ত্রকামী মানুষের দ্বন্দ্ব। এটি একটি মুক্ত জীবন অন্যটি বদ্ধ জীবন। এখানে দ্বন্দ্বটা হচ্ছে আলো ও অন্ধকারের মধ্যে। দ্বন্দ্বটা হচ্ছে সত্য-মিথ্যার। এমন দ্বন্দ্ব পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। এ কারণেই বাংলাদেশের সৃষ্টি। এজন্য একাত্তর সালে আমরা যুদ্ধ করেছি। এখন যে সময়টা আছে তা অন্ধকারের সময়। এই অন্ধকারের ছাপ প্রত্যেকটি জায়গায় পৌঁছেছে। এমনকি পেশাজীবীদের মাঝেও। সুপ্রিম কোর্টের মত জায়গায় পেশাজীবীরা কর্তৃত্ববাদী শাসনের মত রুম তালাবদ্ধ নিজের নাম ঘোষণা করেছে। এমন ঘটনায় বিস্মিত না হয় পারি না। এ থেকে ফিরে আসতে হলে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বর্তমান সময়ে ছাত্র সংগঠন মানুষের কতটা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে?
শামসুজ্জামান দুদু: বর্তমান সময়ে ছাত্র সংগঠনকে অবশ্যই মানুষের কথা ভাবতে হবে। নিজের ভাবনার সাথে এদেশের খেটে খাওয়া শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ে ভাবতে হবে। আগে দেশের সকল ক্ষেত্রে ছাত্ররাই বেশি ভাবতো, তেমনি বিশেষ করে সকল বিষয়ে ছাত্রদের ভাবতে হবে। ছাত্র রাজনীতিতে অতীতে ভূমিকা ছিল, সেই ভূমিকায় ফিরে আনতে হবে। সেই ভূমিকায় ফিরে এলেই পরিবর্তনের দরজা খুলে যাবে আমার বিশ্বাস।
আপনাদের সময়ের সাথে বর্তমান সংগঠনের দূরত্ব কতটুকু? জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কী সঠিক পথে আছে?
শামসুজ্জামান দুদু: ছাত্রদল তো চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে প্রত্যাশিত ভূমিকায় তাদের লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তাদের আরও ছাত্রদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া দরকার কিন্তু তা তারা করতে পারতেছে না। তারা বারবার নির্মমতার মুখোমুখি হচ্ছে। আমরা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ভূমিকা পালন করেছি। তার চেয়েও বেশি নির্মম আচরণ করছেন কর্তৃত্ববাদীর শাসক গোষ্ঠী। এখন তো ন্যূনতম মানুষের অধিকারের কথা স্বীকার করা হয় না। সেজন্য বর্তমান যারা ছাত্র রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করবে। তাদের বেশি সচেতন হতে হবে। আরও বেশি কৈশলি ও সাহসী হতে হবে। সমসাময়িক বাধাকে অতিক্রম করে ছাত্রদলকে মেধা-মননশীল কাজ করতে হবে। ছাত্রদের নিয়ে ভাবতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ছাত্রদলের কাছে জাতি যেটা প্রত্যাশা করে, আমার বিশ্বাস ছাত্রদল সেই প্রত্যাশা পূরণ করবে।
আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শামসুজ্জামান দুদু: ধন্যবাদ।